নীল সমুদ্রের ঢেউ
নীল সমুদ্রের ঢেউ
আজই প্রথম অফিসে আসতে প্রায়ই আড়াই ঘণ্টা দেরি হল আমার । তার বিশেষ কারণ ছিল- সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বুকটা ধূ-ধূ করে উঠল। যে টাকা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম বাজার করবার জন্য, তা দিয়ে কী সব কিনতে পারব! ভাবতে ভাবতে নামছি সিঁড়ি বেয়ে। মাছের বাজারে ঢুকে দাম শুনে, বিভিন্ন মাছ বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে সাহস করে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না দাম কত ? মনে হচ্ছে কেউ আমার মুখে জিকে-গাছের আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। অন্য মানুষ ঠিকই মাছ কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ছেলের দুধ কিনার টাকা যোগ করেও মাছের বাজার থেকে শূন্য হাতে বের হতে হল। আজকাল রাজনৈতিক নামক ইনজেকশন সহজ সরল মানুষের চোখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু মানুষ ফায়দা লুটে খাচ্ছে। আর কিছু মানুষ মাছরাঙা পাখির মতো পুকুরের উপর থেকে সবচেয়ে ছোট মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখেই কারও কারও চোখ বেয়ে নেমে আসছে নরক আগুন।
আমার স্ত্রী শেফালি ভালো মেয়ে; ভদ্র, মার্জিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছে তবে আমার চোখে সে সুশিক্ষায় শিক্ষিত না। হক বা অধিকার যাই বলি না কেন একটা কথা আছে । তাকে অনেক দিন ধরে বলেছি, তোমার বাবা মায়ের জন্য তোমার কিছু করতে ইচ্ছে করে না? স্বামীর টাকা পয়সা তোমার টাকা পয়সা। অথনা নিজে কিছু করে বাবা মাকে দাও। নিজের মনের কাছে দেখবে ভালো লাগবে। ইদানীং তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন পাওয়া যায় না। বলেছিল গত মাসে তিন হাজার টাকা লাগবে। অনলাইনে কিসের যেন একটা কোর্স করবে। এখন অনলাইনে আয়ের একটা ভালো মাধ্যম। আমি জেনারেল লাইনে প্লেইন ডিগ্রি। আজকাল কোনো চাকরি হয় প্লেইন ডিগ্রি দিয়ে? তবুও তো আমি কিছু করে খেতে পারছি পরিচিত কেউ ছিল বলে।
আরও পড়ুন গল্প উপলব্ধি
আমার মতো কত ছেলে ভালো রেজাল্ট করে সারা দিন বাড়ি বসে আছে। চেষ্টা তো করতে হবে। তবে শেফালি সেদিক দিয়ে বেশ চেষ্টা করছে ; হয়ে উঠছে না। মোবাইল ফোন দিয়ে তো সব কোর্স করা সম্ভব না। কম্পিউটার লাগবে অথবা ল্যাপটপ, তা ছাড়া সম্ভব না। অনলাইনে সবাই সাধু না, কিছু মানুষ এমন করে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এটা চরম অপরাধ, অল্প টাকা তাই তেমন কেউ থানায় গিয়ে অভিযোগও করে না। তিন হাজার বা দু হাজার টাকার জন্য আমাদের দেশের মানুষ কারও বিরুদ্ধে কেস করবে এমন মানুষ আমার চোখে পড়েনি। আছে হয়তো যেটা আমি জানি না। একজন মানুষের পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব হয় না।
খালি ব্যাগ নিয়েই আবার উপড়ে উঠে আসতে হল। কলিং-বেল চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল শেফালি। তুমি আজ এত দেরি করলে, তোমার তো অফিসে যাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। ও হ্যাঁ, যাওয়ার সময় ফোনটা নিয়ে যাবে না। তোমাকে লেবু আনতে বলব তা ভুলে গেছি। করোনায় তো আবার নতুন করে বিভিন্ন দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এ সময় একটু ভালো খাবার খাওয়া দরকার। আজ একটা করোনা-কালীন খাদ্যতালিকা অফিস থেকে আসবার সময় প্রিন্ট করে নিয়ে এসো।
আরও পড়ুন গল্প পরনারী
করোনা-কালীন খাদ্যতালিকা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে ঘরের দেওয়ালে টানিয়ে রেখেছি ; আগামী মাসের বেতন পাবার আগেই এ মাসের বেতন শেষ। তবুও সেই করোনা-কালীন খাদ্যতালিকার আর কিছুই কেনা হয়নি। মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যও একটা ভালো টনিক। শেফালির স্বপ্ন চোরাবালির মতো ধসে গিয়েছিল, ডুবে যাওয়া সূর্যের মতো সে তলিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে ।
আজ দুদিন ধরে হেঁটে বাসায় ফিরছি; মনে হচ্ছে নীল সমুদ্রের আগুনের ঢেউ এসে আমাকে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জীবন সমীকরণের সম্মুখে। সব গল্প বলা হয় না, সব গল্প লেখা হয় না। সব-গল্প সবাই পড়ে না।
‘তবুও একটি গল্প থাকে সবার।’
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে