নীলভোর
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

নীলভোর

নীলভোর

শফিক নহোর

 

নুরজাহানের চোখের দিকে আজকাল তাকানো যায় না। ভাবছি একটি চাকরি হয়ে গেলে নুরজাহানকে জানিয়ে দিবো, “আমি তোকে বউ করে ঘরে তুলে নিবো, আমার যে জীবন কখন বাঁচি কখন মরি।” নুরজাহান আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিবে কি? নয় ছয় ভাবতে ভাবতে চায়ের দোকানের সামনে চলে আসলাম।
─ এই! এককাপ বিষ চা দাও হে।
─ সারারাত হনে অকাম করছু হে? চোখমুখ লাল হয়ে আছে।
─ বেটা তুমি বুঝবে লয়। রাজনীতিতে ব্যাপক মজা হে।
─ মজা হবি লয়, পরের তা খালি পরে তো মজাই আলাদা, তোগরে তো মরা লাগবি নে।
─ কাকা, তোমার একখান কথা কই? মানুষের হক না মেরে খেলে কেউ ধনী হতি পারে লয়। সব শালা ধান্দাবাজ। তুমি মানুষরে খাওয়াবা-পড়াবা, তুমি ভাল। যেই উল্টো তালে যাবে, শালা লোকটা সুবিধার না। মানুষের ভিতরে কি মানবতা আছে ? মানুষ এখন হুস ছাড়া প্রাণী। তবে দুই একজন ভাল মানুষ আছে বলেই  দুনিয়াডা সুন্দর ।
─ ঠিক কইছো পলাশ, তোমার কথায় আমি ভোট দিলাম।
─ চা ক্যামবা ল্যাগলি বেটা?
─ মায়ের হাতের রান্না কি কারো খারাপ লাগে? এ শহরে ছোটকাল হতে তোমার হাতের চা। মন্দ হলেও আমার কাছে ভাল। খারাপ মনে করে তো খাইনি। তোমার চা সবসময় ভাল লাগে।
─ আচ্ছা কাকা তুমি জীবনে বিয়া করল্যা না ক্যাহ্? কও তো দ্যেহি? ভাইয়ের বেটা-বেটিকে মানুষ করছো, নিজের ছাওয়াল পলের মত।
─ তোর মাথা লষ্ট হয়া গেছে রে গ্যাদা, যা বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুমদে।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

─ কাকা তোমার একখান কথা কব্যাইর চাই? আমাগোরে পাড়ায় কত মানুষ বড় বড় চাকরি করে , হামিদ কাকার ছাওয়ালের জন্ন্যি সত্যি আমার মায়া হচ্ছে। শোনালাম, দশলাখ টাকা ঘুস! তাও বলে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি। রাজা সরদারের ভাই ইচ্ছে করলে একখান চাকরি নিয়ে দিতে পারে লয়, হামিদ কাকার ছাওয়ালের।
─ তুই কি নতুন করে পাগল হইছিস, এখন কেউ কারো জন্ন্যি মায়া দেখায় না।
─ হামিদ কাকা সৎ মানুষ। তার ছাওয়ালের চাকরি হওয়া দরকার।
─ সৎ পৎ এ সবের কোন বেল নাই। যুগ আয়ছে টাকা ফেকো, দুনিয়া দ্যাখো। বেটারে, আমাগোরে পাড়ার লোকজন হলও চাঁড়ালের বংশধর। ছোটলোক থেকে বড়লোক হইছে; তাদের অন্তরটা কুৎসিত, ফেরাউনের আত্মা, তাঁরা গ্রামের মানুষের জন্ন্যি কিছু করে না। রাজা সরদারের ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্ন্যি, কাশেম কাকার থেকে তিনলক্ষ টাকা নিয়ে চাকরি দিলো না। বেইমান কোথাকার; হজ্জ করে এখন সাধু সাজার ভান ধরছে।

কথা বলতে বলতে মিছিলের শব্দ কানে আসতে লাগলো। ঘার ঘুরিয়ে দেখলাম, এক সঙ্গে কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলো।
─ কাকা তুমি দোকানে থাকো আমি যাই। তুমি দোকানের জাপ বন্ধ করে ভিতরে লক মারি বসে থাহ। খবরদার বের হবুলয়।
─ ধুর বেটা, আমি বুড়া মানুষ, মরি গেলে কান্দনের কেউ নাই। এ বলে হাকেম কাকা এগিয়ে গেল। তোমাগোরে যৌবনকাল বেঁচে থাকলে গ্রামের মানুষের চাকরি দিও আল্লাহর দোহাই লাগে।

কাকার বুকে তিনটা বুলেটের চিহ্ন। আমার হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে; ‘মানুষ মরে গেলে পরে এত সুন্দর চেহারা হয়!’
মনে হচ্ছে কাকা আমার মুখের দিকে তাকায়ে কচ্ছে,
─ বেটারে ভাল মানুষের এ জগতে এখন আর দাম নাই, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন গল্প লালু

এমন একদিন হাকেম কাকার ছিল; মানুষের টাকাকড়ি পায়ের তলায় পড়ে থাকতো, চোখ তুলে তাকানোর সময় ছিলো না। বাতাসে উড়িয়ে নেয়া শিমুল তুলার মত দুরন্ত যৌবন পার করেছে ভাবনাহীন। আজ মানুষটা পরের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকে, কে তার দোকানে চা খাবে। সংসারের অভাব চোখে পড়ার মত। পাশের বাড়ির মধু ব্যাপারী মস্ত বড় অফিসার, কাকার ছাওয়ালের কি একটা পিয়নের চাকরি দিতে পারে লয়?
মধু হাজি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় এ রাস্তা দিয়ে মসজিদে যায়।  একদিনও বাজানের চিৎকার কি তাঁর কানে যায়নি? তবুও একদিনেও জিজ্ঞাসা করলি লয়,
─ নুরজাহান তোর বাবা এত জোড়ে চিৎকার করে কেন?
ফেতরার টাকা নিয়েই ছলচাতুরী করেছিল মধু হাজি, তার জুয়ারি ছাওয়াল মিথ্যা বলেনি ,
─ সে টাকা বাজান মাটির ব্যাংকে জমা রাখছে; মানুষটার এক পা কবরে চলে গেছে। যুবতি মেয়ে দেখলে দুর্বল হাত এগিয়ে দিয়ে বলবে,
─ আমাকে একটু রাস্তা পার করে দাও হে?
আমাকে একদিন জড়িয়ে ধরেছিল, সংসারের অভাব, বাবা অসুস্থ। আইয়ে পাশ করে বাড়িতে বসে আছি। কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। চোখ দিয়ে দেখেছে আমার বাড়ন্ত শরীর, লোভী শুকুনের মতো। না খেয়ে পড়ে আছি সেদিকে কারো চোখ নেই। সব শয়তানের দল বেটা মানুষ।
‘আমাগোরে দারিদ্র্যের হাহাকার ও অমানবিকতার চিৎকার ধনী মানুষের কানে যায় না কখনো।’

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

ক’দিন ধরে ভাবছি; নুরজাহানকে বিয়ের কথাটা বলতে যাবো, এর আগে কত মানুষ কত কথা বলছে , গতর ভাড়া দিয়ে আড়ালে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে; এমন কত কথা কানে আসে।
নুরজাহানের অন্তিম বাসনা শেষ বিচারের মালিকের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

বাড়ির পাশের ধনী মানুষের সুখের ঘ্রাণ নাকের ডগায় হরহামেশা আসে। পৃথিবী নামক রঙ্গলয়ে মানুষ  আনন্দ-উপভোগে নিমজ্জিত, কিছুকাল কাটিয়ে দেয়। চলে যাবার কথা ক’জন ভাবে?
শিক্ষিত মানুষ গ্রাম ছেড়ে, বাবা মাকে ছেড়ে, সুখী হতে শহরমুখী হয়! শেষ বয়সে আবার সেই গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে আসে। বুকের ভিতরে হাজারটা অপরাধ-বোধ বুকে নিয়ে, তখন প্রয়োজন হয় নুরজাহানের মতন মানুষের। তখন ঠিকই খুঁজে বের করবে এ গ্রামে কে অভাবী, কে তার বাড়িতে বাদীর কাজ করবে।

দারিদ্র্য-পীড়িত মধ্য রাতের আলো-অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় মধু হাজি, অমানুষ হয়ে উঠেছে , সুদখোর সমাজ-শোষক ধনী মহামানেবর প্রতীক।
স্বেচ্ছায় হেরে যায়নি নুরজাহান, সমাজের নামি দামি ধনী অফিসার নুরজাহাকে কাজ দিয়েছিল! গতরের ম্যাসেজ করবার, বউ অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে, কানের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলতো ,
─ কাউকে বলিস না কিন্তু,পাপ হবে।
নুরজাহান চিৎকার করে বলে উঠেছিল ,
─ অস্বীকার করবে এ সন্তান তোমার না?

আরও পড়ুন  গল্প পরাজিত নাবিক

─ নুরজাহান আমি তোমাকে এখান থেকে নিতে এসেছি।
─ পলাশ, ‘তুমি এখান থেকে ফিরে যাও?’
─ আমি বিয়ে করবার জন্যই তোমাকে নিতে আসছি;
─ এই তোমার মাথা ছুঁয়ে কচ্ছি? আমি পাপী মানুষ। আমাকে ঘরে নিয়ে তুমি সুখী হবে না। বাড়ির মানুষ, পাড়ার মানুষ, বিষমুখে যা বলবে, তোমার প্রেম আর তখন প্রেম থাকবে না। আমি এই বেশ ভাল আছি, আমাকে কেউ বেশ্যা তো বলছে না। তুমি বেটা মানুষ, অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার করো। আমার গতরে অমানুষের রক্তে শরীর নীল হয়ে গেছে ঘৃণায়, তুমি ফিরে যাও পলাশ।

স্যার, ‘আমি প্রতিরাতে প্রার্থনায় আমার বরের নিকট ক্ষমা চাই! এই জাগতিক পৃথিবীর মানুষ আমাকে কিছুই দেয়নি।’ গতর বিক্রি করে অসহায় বাবাকে চিকিৎসা করিয়েছি, জানি না তিনি ক্ষমা করবেন কিনা। আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না কোনদিন। আপনি চাইলেই আমাকে একটা চাকরি দিতে পারতেন। চাকরি দিয়েছেন বটে, আপনার বাড়ির বাঁদির কাজের, তার বিনিময়ে আমার পবিত্র শরীরে অমানুষের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এত টাকা ঘুস খেয়েছেন, এখন তো রাতে এক রুটি ছাড়া কিছুই মুখে যায় না আপনার। সবার মরণ হয় আপনার মরণ হয় না কেন, স্যার?

আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
অন্তর্জাল ও মৃত্যু
খোয়ার
অতিথি আসন
অচেনা
তৃতীয় স্বাক্ষী

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

নীলভোর

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!