নাজিরগঞ্জ,  নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের ইতিহাস ও ঐতিহ্য,  মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিযুদ্ধে সুজানগর

নাজিরগঞ্জে পাকবাহিনীর ফেরি ধ্বংস

সিদ্ধান্ত নিলাম কপালে যা-ই থাকুক, এদের ছাড়া যাবে না। আমাদের কাছে একটি আরসিএল গান, ছয়টি ব্রিটিশ এলএমজি, বাকি সবার কাছেই এসএলআর এবং রাইফেল। নদীর পাড়ে বিভিন্ন উপযুক্ত স্থানে পজিশন নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। এমনভাবে পরিকল্পনা করলাম, যাতে আর্মিরা বুঝে ওঠার আগেই আমরা ব্যাপক আক্রমণ করে তাদের খতম করে দিতে পারি। একজনকে পাঠিয়ে দিলাম গ্রামের অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিতে, যাতে সবাই প্রস্তুত হয়ে চলে আসে।

আরও পড়ুন সুজানগর হানাদার মুক্ত দিবস

সহযোদ্ধাদের বলে দিলাম আমি যখন আরসিএলগান ফায়ার করব তখন সবাই একসঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু করবে। প্রথমে শুধু তিনজন এলএমজির ব্রাশফায়ার করে এক ম্যাগাজিন খালি করে ফেলবে। আর বাকি তিনটি এলএমজি রেডি থাকবে; অবস্থা বুঝে ফায়ার করতে হবে। ইতিমধ্যে আগের তিনজন ম্যাগাজিন গুলি লোড করে ফেলবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ হলো, আমাদের এলএমজির ম্যাগাজিন ছিল মাত্র একটি করে, যা ব্রাশফায়ার করলে মুহূর্তে গুলি শেষ হয়ে যায়।

আরসিএলগানের বাইনোকুলার খুলে দূরে দেখলাম, কিন্তু ফেরি ছাড়া তেমন কিছু বোঝা গেল না। দুপুর প্রায় ১২টার দিকে ফেরি আমাদের কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। দেখলাম ফেরির দোতলায় খোলা জায়গার মধ্যে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আর্মির ড্রেস পরা কাউকে দেখলাম না। ধারণা করলাম, এরা পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য। আমাদের অস্ত্র লোড করে একদম রেডি, আমাদের ওরা দেখতে পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে ওরা আমাদের সীমানার মধ্যে এসে পৌঁছাল। আর সঙ্গে সঙ্গে ফেরির নিচের দিকে তাক করে আরসিএল গান ফায়ার করলাম। বিকট শব্দে ফেরি কেঁপে উঠল। এর পর আরসিএল গানে আরেকটি শেল লোড করে ফেললাম। আমার ফায়ারিংয়ের পর বাকি মুক্তিযোদ্ধারা ঝড়ের মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে দিল।

আরও পড়ুন  একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি

অন্যদিকে মিলিশিয়া বাহিনীও আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। হঠাত্ দেখলাম ফেরি খুব জোরে এসে নদীর পাড়ে ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেয়েই ফেরির ইঞ্জিনের স্পিড বেড়ে গেল। ফেরি চলে যাচ্ছে মনে করে আবার আরসিএল গান ফায়ার করলাম। এদিকে আমাদের সবার এলএমজি আর এসএলআর একসঙ্গে গর্জে উঠল। এবার ফেরির ইঞ্জিনের শব্দ থেমে গেল, ফেরি সোজা এসে পাড়ে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেল। আমরাও গুলি করা বন্ধ করে নিজেদের পজিশনে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ইতিমধ্যে ফেরির দোতলা থেকে কিছু লোক রাইফেলের সঙ্গে জামা বেঁধে করে ‘জুই বাংলা, জুই বাংলা’ বলে চিত্কার করতে শুরু করল। বুঝলাম ওরা পাকিস্তানি, বাংলা বলতে পারে না।

আমি পজিশনে থেকেই চিত্কার করে বললাম, ‘তোদের যেকোনো তিনজন নেমে আয়। আর সবাই হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাক।’ তিনজন নেমে এল। ওদের ফেরির শিকল নদীর পাড়ের এক খেজুরগাছের সঙ্গে বাঁধতে বললাম। তারপর হাত ওপরে তুলে সবাইকে একে একে নেমে এসে তহসিল অফিসের পাকা বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকতে বললাম। তারা তহসিল অফিসে প্রবেশের পর আমরা পজিশন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। যোদ্ধাদের সবাইকে বিল্ডিংয়ের দরজা বন্ধ করে পাহারা দিতে বললাম। আমি কজনকে নিয়ে ফেরির ওপরে উঠে গেলাম। দেখলাম, তিনতলায় সারেংয়ের রুমে গুলি লেগে কয়েকজন মরে পড়ে আছে। তাদের মধ্যে চারজনকে ফেরির চালক মনে হলো আর বাকিরা মিলিশিয়া। তিনতলা ও দোতলায় আরও কয়েকজন মিলিশিয়া বাহিনীর সেনা ও রাজাকারের লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। নিচতলায় চারজন রাজাকার আর ১১ জন মিলিশিয়া বাহিনীর মৃতদেহ পাওয়া গেল। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ মিলিশিয়া বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সেনা ও ১২ জন রাজাকার নিহত হয়েছিল। আরসিএল গানের শেলের আঘাতে ফেরি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলেও পানি থেকে ওপরে লাগার ফলে ফেরি ডুবে যায়নি।

আরও পড়ুন  পাবনায় প্রথম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল

ফেরিটি পাকিস্তানি আর্মির রেশনসামগ্রী নিয়ে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাচ্ছিল। ফেরিতে ৪৭টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, প্রচুর গুলি, ২৫ ড্রাম কেরোসিন তেল, ১০০ বস্তা চাল, ২৫ বস্তা ডাল, চিড়া, চিনি, বিস্কুট, সরিষার তেল, নতুন চাদর, সোয়েটার, কম্বল, লেপ-তোষকসহ এ ধরনের প্রচুর মালপত্র পাওয়া গেল।

ইতিমধ্যে যুদ্ধের খবর পেয়ে আর গোলাগুলির শব্দ শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই দৌড়ে এসে হাজির হয়েছে এখানে। আশপাশের গ্রামের লোকজন জমা হয়েছে প্রায় হাজার খানেক, সবার সে কী আনন্দ! অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমরা ফেরি থেকে নামিয়ে নিয়ে এলাম। মনে হলো, আমাদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র নদীতে ফেলে দিয়েছিল। রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর লাশগুলো ফেরি থেকে নদীতে ফেলে দিলাম। যুদ্ধে নিহত মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকারদের সবার কাছেই আইডেনটিটি কার্ড ছিল। মিলিশিয়া বাহিনীর সেনাদের প্রায় সবার বাড়ি পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার এবং ওয়াজিরিস্তানে। রাজাকারদের ঠিকানা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, পাবনা জেলার কোনো রাজাকার তাদের সঙ্গে ছিল না।

আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে ফেরির সব মালপত্র নামিয়ে দূরে নিয়ে গিয়ে সবার মধ্যে সঠিকভাবে বিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ফেরির মালপত্র সব খালি হয়ে গেল। এরপর ফেরি ধ্বংস করে ডুবিয়ে দেওয়ার পালা। কিন্তু বিপদ হলো সম্পূর্ণ লোহার তৈরি কিছুতেই ভাঙা গেল না। আগুন ধরিয়ে দেব, কিন্তু কোথায়, বহু চিন্তা করে ফেরির ডিজেল ট্যাংকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক টুকরো টায়ার কেটে আগুন ধরিয়ে ডিজেল ট্যাংকের ভেতর ফেলে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা আকাশ কালো করে ধোঁয়া উঠতে থাকল। মনে হলো, ট্যাংক ব্রাস্ট হয়ে ফেরি ডুবে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। প্রায় ১০ মিনিট প্রচুর ধোঁয়া বের হয়ে আবার সবকিছু নীরব হয়ে গেল।

আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়

বাধ্য হয়ে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করতে হলো, যা আমি নষ্ট করতে চাইছিলাম না। এরপর ফেরির ভেতর ঢুকে তলায় চার পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ডেটোনেটরের সঙ্গে কর্ডেক্স দিয়ে এক্সপ্লোসিভ পেঁচিয়ে দিলাম। এর সঙ্গে প্রায় তিন ফুট সেফটি ফিউজ লাগিয়ে মাটির একটি বস্তা দিয়ে চাপা দিলাম এক্সপ্লোসিভ। এরপর সেফটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে ফেরি থেকে নেমে এলাম। প্রায় পাঁচ মিনিট পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে ফেরিটি ডুবতে শুরু করল। দ্রুত ফেরির শিকল খুলে দিলাম, স্রোতের টানে ফেরি ধীরে ধীরে ভেসে যেতে শুরু করল। অল্প কিছুদূর গিয়েই নদীর তলায় ফেরি আটকে গেল। কিন্তু নদীর পানি এত গভীরতার মধ্যেও ফেরির তিনতলার কিছু অংশ জেগে রইল। আমরা এলাকা ছেড়ে বিদায় হলাম। ফেরির কিছু অংশ জেগে থাকায় একটি লাভ আমাদের হয়েছিল। ওই নদীপথে আর্মিদের গানবোট বা বড় ধরনের লঞ্চ বা কার্গো চলাচল করতে পারত না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই খবর পাঁচ দিন পরে প্রচার করা হয়েছিল।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

নাজিরগঞ্জে পাকবাহিনীর ফেরি ধ্বংস

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!