দীপ্তিদের দেবতা (১ম পর্ব)
দীপ্তিদের দেবতা (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
এ বছরে ভাগ্যটা সত্যিই সুপ্রসন্ন। অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে পদোন্নতি আর পদায়ন জেলা শহরে নামকরা কলেজে। প্রমোশন এবং পদায়ন দুটোই আমার জন্য একটা সাফল্য। কিন্তু গিন্নী আর বাচ্চারা মনঃক্ষুণ্ন। এত দিনের পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে। বদলী ঠেকানোর কোন উপায় নেই। উপায় একটাই প্রমোশনটা যদি না নেই। গিন্নীকে অবগতি করতেই একবাক্যে বাতিল করে দিলেন। হাজার হলেও প্রফেসরের জীবনসঙ্গিনী। সমাজে আলাদা একটা পরিচয় আছে। কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায়। বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। ওৎপেতে বসে থাকে। শুধু সময় মত কাজে লাগানো যায় কিভাবে।
মফস্বল শহর হতে জেলা শহরে বাসান্তর। প্রায় পাঁচ বছর একই বাড়ীতে বসবাস করার দরুন বইপত্র, ম্যাগাজিন তো আছেই আরো সাথে আছে গিন্নীর সংসারের হাজারো জিনিষপত্র। গোঁছগাছ করা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেক পুরনো ম্যাগাজিন বাতিলের খাতায় নাম উঠেছে। গিন্নী একান্ত মনে ম্যাগাজিনগুলো বেছে বেছে আলাদা করে রেখে দিচ্ছে ন। হঠাৎ একটা ম্যাগাজিনের ভেতর হতে পরমা সুন্দরী যুবতীর রঙিন ছবি ধপাস করে গিন্নীর কোলের ওপর পতিত হলো। গিন্নী সযত্নে হাতে তুলে নিলেন। এক দৃষ্টিতে ছবির ওপর দুটো ডাগর ডাগর আঁখিদ্বয় নিক্ষেপ করলেন। পাশেই বসেছিলাম। আমার দৃষ্টি পড়লো গিন্নীর মুখের ওপর। হঠাৎ তার মুখমন্ডল আষাঢ়ের কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। কিছু বলার আগেই সিংহের মত হুংকার দিয়ে উঠলেন।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
- এই ফটো কোন মহিলার? এর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?
গিন্নীর চেহারা দূর্গামূর্তি। ভাগ্যিস ছেলে-মেয়ে দুটো কাছে নেই। তারা তাদের জিনিষপত্র গোজানোর কাজে ব্যস্ত। যাইহোক, ছবি হাতে নিয়ে বেশ ক’বার ভাল করে দেখে নিলাম।
- কি দেখার স্বাদ মিটলো না? মনে হচ্ছে সুন্দরী মহিলাকে গিলে খাচ্ছো।
কিন্তু আমার স্মৃতির পাতায় এ ধরনের মহিলার সাথে কস্মিনকালে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা মনে পড়ছে না। ভাবলাম আরো একটু চিন্তা করে নেই ঠিকই এই ছবির রহস্য বের করা যাবে। তাই কিছু না বলে সোজা রান্না ঘরে গিয়ে দু’কাপ চা তৈরি করে এনে গিন্নীর হাতে দিয়ে বললাম,
- চা পান করে নাও। পরে বলছি।
তখনো ছবির বিষয় মনে পড়ছে না। চা পান করছি আর ভাবছি এই ছবিটা কার হতে পারে। গিন্নীর সাথে তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছি, তাই অন্য কোন মেয়ের ফটো দেখা বা রাখার কোন প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু অবলা মহিলাকে কি বলে বুঝাবো। হঠাৎ স্মৃতি পাতায় ভেসে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের সহপাঠি আসাদের কথা। ফটো আসাদ পাঠিয়েছিল। ওর বিয়ের কনে হিসেবে। গিন্নীর সাথে আসাদের পরিচয় আছে। বিষয়টি বিস্তারিত বলার পর গিন্নীর চেহারার ভেতরে নমনীয়তা আবহাওয়া বয়ে গেল। আর আমি এক ভয়ংকর বিপদ হতে রক্ষা পেলাম।
আসাদ আর আমি দু’জনেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং অর্নাস-মাস্টার্স এক সঙ্গে করেছি। ওর ছিল সমাজ কল্যাণ আর আমার অর্থনীতি। শহীদ জোহা আবাসিক গণ হলে বাসিন্দা আমরা। তখন হতেই পরিচয় এবং পাক্কা বন্ধু। পঞ্চগড়ের ছেলে আসাদ। ভাবুক টাইপের ছেলে। পরিচয়ের শুরুতে বলেছিল সে জীবনে এক লাইন কবিতা লেখেনি। সহজ- সরল মনের মানুষ আসাদ।
-দোস্ত, আমি কিন্তু ছাত্র হিসেবে থার্ড ক্লাস। বলতে পার বিদ্যালক্ষী আমাকে এখানে টেনে এনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি তাই বাবা-মার চোদ্দ পুরুষ যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছে। ভর্তি হও টাকা দিবে গৌরসিং।
আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
সেই আমার বন্ধু আসাদ। পকেটে টাকা থাকলে কোন কথা নেই। পথকিশোর-কিশোরীদের নিয়ে হোটেলে এক সাথে বসে দুপুরের ভাত খাওয়া। আর কত রকমের পাগলামী। বেশ সময় কেটে যাচ্ছে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমাকে একটু বেশি সময় দিতে হয়। লাইব্রেরী ছাড়াও বন্ধুদের সাথে অর্থনীতির কঠিন তত্বগুলো আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নিতে হয়। আসাদ চলে তার জগতে। হলে সিট পেয়েছি। দুজনে একই রুমে। আসাদ সকালে বের হতো আর রাতে হলে ফিরতো। ও ঠিকই বলেছিল বিদ্যালক্ষী ওর সহায়। পরীক্ষার তিন মাস আগেই নোট সংগ্রহ করে একটানা পড়ে সম্মানজনক ফলাফল করেছে। ওর ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে, তাই লেখাপড়া নিয়ে বেশি আলোচনা হতো না। অর্নাস পরীক্ষা আর বেশি দেরী নেই। তবে এটা বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়ে থাকে। হঠাৎ একদিন সকালে আসাদের বাবা হাজির। বাবার জন্য কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমি ওর সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
- শোন, তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না। বাস হতে নেমেই পেট ভরে নাস্তা খেয়ে এসেছি। তোমার মার তাগিদে আসতে বাধ্য হলাম।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
- বাবা তোমার কথা শুনেছি। তাই ওর নিয়ে আমার কোন দুঃচিন্তা নেই। একবার দেখে যাচ্ছি। টাকা পয়সার কোন অসুবিধা নেই। হঠাৎ আমার হাত ধরে আবেগময়ী কণ্ঠে বললেন,
- বাবা, তুমি একটু খেয়াল রাখবে। ও যেন খারাপ লোকের পাল্লায় না পড়ে।
তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম। এই তিন বছরে আসাদকে কখনো ধুমপান করতে দেখেনি। ওর একটাই দোষ বলি, আর গুণ বলি, তা হলো অসহায় গরীব মানুষের জন্য হৃদয় ছিল খোলা। অনেক ছাত্রের টিউশন ফি বকেয়া থাকায় পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আসাদ দানশীল হাজী মহসিন হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসের আশেপাশে পথশিশুর আসাদের ভক্ত। যাইহোক আসাদের বাবা জানিয়ে রাখলেন, আজ রাতের বাসে পঞ্চগড়ে ফিরে যাবেন। টিকিট করে এনেছেন। তাকে হলে রেখে আমরা বের হয়ে গেলাম ক্লাসের উদ্দেশ্যে। আসাদ এখন মনোযোগী।
আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা
আসাদ তার বাবাকে রাত আটটার গাড়ীতে তুলে দিয়ে একটু দেরীতে হলে ফিরলো। মনটা খারাপ, তাই কোন কথা হলো না। পরীক্ষার বেশি দেরী নেই। অর্থনীতি কঠিন বিষয়।প্র থম শ্রেণি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ক্লাসে আরো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী আছে। তবে সন্তোষজনক ফল হলেই চলবে। বাকী সময়টা নষ্ট করা ঠিক হবে না।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে গেল। চলছে পরীক্ষা নিয়মমাফিক। আসাদ তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। আসাদের পরীক্ষা শেষ। আমারও দুটো বিষয় অবশিষ্ট আছে। তাই নিয়ে ব্যস্ত আছি। হঠাৎ সকালে আসাদ কাপড়-চোপড় পরে একটা ব্যাগ হাতে করে কাছে এসে মৃদুস্বরে বললো,
- দোস্ত, দুদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস রাখিস কোন বাজে কর্মে হাওয়া হচ্ছি না। নিয়ত ভাল। ফিরে এসে সব বলবো।
আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বললাম,
- সাবধানে থাকিস।
দুদিন পরে আসাদ ঠিকই ফিরে এসেছে। কিন্তু পরীক্ষার ব্যস্ততায় কিছু জানা হয়ে উঠে নি। আমিও ভুলে গেছি। বিষয়টি যদি আসাদের একান্তই ব্যক্তিগত হয়ে থাকে তাহলে ওর মুখ হতে শুনাই বাঞ্ছনীয়।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
আমারও পরীক্ষা শেষ। আছে মৌখিক পরীক্ষা। আসাদ রুমে নেই। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ায় আর ফেরে রাতে। জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হেসে বলে,
- দোস্ত, সমাজ কল্যাণ পাঠ করছি তাই সমাজকে দেখছি।
দুপুরে খেয়ে এসে সবেমাত্র বসেছি। এমন সময় হল বেয়ারা এসে খবর দিলো, রমজান নামে একজন লোক আসাদ স্যারকে খোঁজ করছে। রমজানকে ভাল করেই জানি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে তার বসার জায়গা। ভর্তি হওয়ার পর হতে রমজানকে দেখে আসছি। তার একটাই কথা,
- স্যার, ঘরে বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে। কিছু সাহায্য করেন, দোয়া করবনে।
আজ প্রায় তিন বছর ধরে এই ডায়ালগ সবাই শুনে আসছে। যারা নতুন ভর্তি হতে আসে তারা রমজান চাচাকে ভাল বকশিস দিয়ে থাকে। সবার কাছে সে রমজান চাচা। রমজান চাচার কথা শুনে মনের ভেতরে খটকা লাগলো। দুপুর বেলায় আসাদের খোঁজে একেবারে হল পর্যন্ত আগমনের হেতু কি? মেয়ের বিয়ের জন্য কি আসাদের শরণাপন্ন হয়েছে? যাইহোক শার্টটা পরিধান করে হাজির হলাম।
ও বাবা! এ কি। রমজান চাচাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, পরনে নতুন লুঙ্গি, পায়ে স্পঞ্জের চপল। মুখের দাড়িগুলো সদ্য ফুটপাত সেলুন হতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে এসেছে। চেহারায় আগের মত দারিদ্রের ছাপ নেই।
- তা রমজান চাচা কি মনে করে। মেয়ের বিয়ের খরচাপাতি লাগবে নাকি। তাছাড়া আসাদ তো হলে নেই, সন্ধ্যার আগে ফিরবে না।
আমার কথা শুনে রমজান চাচা তার পুরা জিব্বা বের করে বলল,
- স্যার কি যে বললেন। আসাদ স্যার তো গত সপ্তাহে আমার মেয়ের বিয়ের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। গ্রামে ছোট একটা দোকানের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন। ভাল আছি স্যার। স্যারকে বলবেন আমার সংসারের সবাই তার জন্য দোয়া করছি। এখানে কিছু মিষ্টি আছে। দোয়া করবেন আর যেন ভিক্ষে করতে না হয়।
সালাম দিয়ে একজন গর্বিত স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে বের হয়ে গেল। আমি শুধু আসাদের কথা ভাবছি। তাহলে গত সপ্তাহে এই শুভ কার্যসম্পন্ন করতে হাওয়া হয়েছিল। আসাদ তুমি মহান। তোমাকে স্যালুট। মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রুমে এসে আসাদের টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।
আরও পড়ুন গল্প নীল সমুদ্রের ঢেউ
সন্ধ্যার পর রুমে ঢুকতেই মিষ্টির প্যাকেটে প্রতি চোখে পড়লো। মনে মনে ভেবে নিলাম বিষয়টি গোপন রাখব। কিন্তু কথাটা আর গোপন রাখতে পারলাম না।
- আসাদ, শ্বশুর সাহেব এসেছিলেন জামাইয়ের খোঁজে।
- দোস্ত, কেমন লাগলো?
- প্রথমে তো চিনতে পারিনি।
অভিমান না করে দুজনে ছয়টা মিষ্টি খেয়ে দোয়া করলাম। আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছিলেন কিনা জানি না। তবে আসাদ মানবিক কাজটাই করেছে। একজন মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তি হতে কর্মের পথে আনতে পেরেছে। আমরা সবাই যদি ওর মত হতে পারতাম তাহলে সমাজের অসহায় গরীব মানুষকে কর্মের পথে আনতে সাহায্য করতে পারতাম। অর্থনীতির পরিভাষায় বলে স্বনির্ভরতা। আমরা গাল ফুলিয়ে প্রতিদিন জ্ঞান দেই জনগনকে। কিন্তু উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি না।
এত দিন পর কথাগুলো মনে পড়তেই মনের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে অশ্রু টপটপ করে পড়তে লাগলো।
- তোমার কি হয়েছে?
এই ঘটনা আমার গিন্নীকে বলেছিলাম। আসাদের কথা বলতেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,
- খোঁজ নেয়া উচিৎ। আসাদ ভাই লজ্জায় আমার মুখের দিকে তাকাতে পারতেন না।
- ও বলতো, হবু ভাবীর আঁখি দুটো তোকে আগলে রাখবে। এত সুন্দর আঁখি আগে কখনো দেখেনি।
- আসাদ ভাই যে ছবিটি তোমাকে পাঠিয়েছিল, তিনি পরমা সুন্দরী এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েটির বয়স বিশের নীচে বলে মনে হচ্ছে। সুন্দরী দেখেই মনে হয় বয়সের পার্থক্য ভাবে নি। ওর ঠিকানা কি তোমার মনে আছে? মনে করার চেষ্টা কর। নতুন জায়গায় গিয়ে চিঠি লিখবে।
সেদিনের মত একটা সাংসারিক প্রলয়ের হাত হতে রক্ষা পেলাম। গিন্নীর মনে অহেতুক সন্দেহ দূর হলো।
আরও পড়ুন দীপ্তিদের দেবতা গল্পের-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
দীপ্তিদের দেবতা (১ম পর্ব)