দীপ্তিদের-দেবতা-শেষ-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

দীপ্তিদের দেবতা (শেষ পর্ব)

দীপ্তিদের দেবতা (শেষ পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

গোসলখানায় গিয়ে দেখি নতুন লুঙ্গি, গামছা এবং গেঞ্জি আর বড় দুটো বালতি ভরা পানি। একটি বালিতে গরম পানি। ভাবছি, একেই বলে খান্দানী। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে গোসল করে নিলাম। গিন্নীর দেয়া কোন কিছু ব্যবহার করতে হলো না। সযত্নে রেখে দিলাম। তবে পাঞ্জাবী-পাজামা পরিধান করে নতুন জামাই সেজে ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকলাম। এমন সময় চৌদ্দ-পনের বছরের একটা মেয়ে রুমে ঢুকে সালাম দিলো।

  • আমার নাম ঝুমুর। চলুন নাস্তা খাবেন।

শান্ত স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার নরম আলো মাখানো চেহারা। স্বাভাবিক পোশাকে অপূর্ব লাগছে। কিছু না বলে ঝুমুরকে অনুসরণ করলাম। ছিমছাম খাবার ঘর। খাবার ঘরে কি নেই। শহরের ডাইনিং রুম আর গ্রামে খাবার ঘর। কিন্তু এই বাড়ীর খাবার ঘর কেন যেন স্বতন্ত্র মনে হলো। পিছনে খোলা দীঘি ভরা পানি থৈ থৈ করছে। তারপর দিগন্ত জুড়ে মাঠ। শুধুই অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি এ কোন জাদুপুরীতে আগমন হলো। ঠিক জায়গায়  এসেছি তো। এখন দিন, না রাত। সূর্য তো দেখা যাচ্ছে না। আসাদের পিছে একজন মহিলা আর তার পিছে ঝুমুর। একই বয়সে দেখতে অবিকল আর একটি মেয়ে। দুটোই যমজ এতে কোন সন্দেহ নেই।

খাবার ঘরে আমি ব্যতিত আসাদসহ পাঁচ জন। আসাদের মা একজন বিচক্ষণ মহিলা এবং সংসারের কর্তৃত্ব এখনো নিজের হাতে রেখেছেন। পরিচয় পর্বে জেনে গেলাম আসাদের দুটো যমজ কন্যা। ঝুমুর-নুপুর। আসাদের আরো দু’বোন আছে তারা বিবাহিত। আসাদের বাবা বেঁচে থাকতেই তাদের সবকিছু ভাগ করে দিয়ে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের পছন্দের মেয়েকে ছেলের বৌ করে ঘরে এনেছেন। বৌমাই তো সংসারটা আগলে রেখেছে। হঠাৎ আসাদের মা উঠে দাঁড়ালেন।

  • বাবা, তোমরা নাস্তা খেতে খেতে গল্প করো।
আরও পড়ুন  গল্প পক্ষিরাজের ডানা

এক গাল মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেলেন। ঝুমুর-নুপুর দুজনে আমার দুপাশে বসলো। যেমন বাসায় আমার দুটো ছেলে মেয়ে করে থাকে। এবার মনের ভুল ভাঙ্গল। সেই ছবিওয়ালী পরমা সুন্দরী ইনি নন। তাহলে কে? এটা কি একটা কৌতুক? তবে আসাদের স্ত্রীর চেহারায় ভরে আছে সরলতা। যে সরলতায় তাকে দেখতে দারুণ লাগছে। কথা বলছেন বেশ গুছিয়ে এবং শুদ্ধ বাংলায়। কথায় একটু জড়তা নেই। সুন্দরীদের কাতারে পড়ে না তবে ব্যক্তিত্ব মার্জিত এবং রুচিসম্পন্ন একজন সচেতন মহিলা। মাস্টার মানুষ তো অল্প দর্শনে লোক চিনতে ভুল হয় না। আমার মনেই হচ্ছে না আমি এই পরিবারের নতুন সদস্য। দুটো মেয়ে বেশ হাসিখুশি এবং তাদের মধ্যে দারুন ভাব। আমার পরিবার সম্পর্কে তাদের অবগত করলাম। আগামী শীতে সপবিরাবে আসব। মেয়ে দুটো শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। আসাদ তাড়া দিলো। বেলা নয়টা বাজে। এখনই বের হতে হবে।

  • পোশাক পরিবর্তন করার কোন দরকার নেই। প্রস্তুত হয়ে নাও।

একটা জিনিষ মনে হলো, আসাদের জনহিতকর কার্যকলাপ বাড়ীর কেউ বাধা দেয় না। পরিবারের সবাই সাহায্য করে। আসাদের মার কথাবার্তা শুনে মনে হলো এরা প্রচুর সম্পত্তির মালিক। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা বের হলাম। সেই অটোরিক্সা। গন্তব্যস্থলে পোঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। মানে সকাল এগারটার ভেতর। নজরে পড়লো জায়গায়টা সবুজে পরিবেষ্টিত, বসতি হালকা। তবে এলাকার বাসিন্দা অবস্থাসম্পন্ন। আসাদ এলাকার মানুষ সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলো। আগে কেউ লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী ছিলো না। আসাদসহ আর তিন জন প্রথম মাস্টার্স করেছেন। আসাদ ব্যতিত অপর দুজন সরকারী চাকরি করেন এবং একজন বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। আসাদের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালকের পদে চাকরি হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনচেতা মন, তাই যোগদান করে নি। গ্রামে ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশ পড়ালেখা করে। নিকটবর্তী একটা স্কুল এন্ড কলেজ আছে। অটোরিক্সা একটা গ্রামের মধ্যে ঢুকলো। গ্রামটা দেখে মনে হলো নিম্নমানের সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে বসবাস করে। তবে একটা বিষয় চোখে পড়লো, উন্নয়নের ছোঁয়া কিছু পড়তে শুরু করছে। গরীব হলেও বাড়ী-ঘরগুলো ছিমছাম পরিস্কার-পরিচ্ছন।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

আটোরিক্সাটা একটা বাড়ীর সামনে এসে থামলো। অটোরিক্সার শব্দ শুনে পাঁচ-ছয় বছরের  ফুটফুটে কল্পনার পরীর মত একটা মেয়ে ছুটে এলো। দেখে আমার চক্ষুস্থির। এ কি দেখছি! কার পাল্লায় পড়েছি। আসাদ নামতে তাড়া দিল। আসাদ তার পাঞ্জাবীর পকেট হতে একমুঠো চকলেট বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে আদর করলো। একটু পরে তেইশ-চব্বিশ বছরের একজন মহিলা এসে দুহাত তুলে নমস্কার বলে ভেতরে আসার অনুরোধ করল। মহিলার পানে চাইতে রবি ঠাকুরের কৃঞ্চকলির কথা মনে পড়লো। লম্বা বেনী করা চুল পিঠ ছাপিয়ে কোমর অব্দি পড়েছে। মিষ্টি মাখা হাসি আর দাঁতগুলো কি সুন্দর। এ রকম যাদের গায়ে রঙ তাদের দাঁতগুলো নাকি দেখতে খুব সুন্দর হয়। কথাটা মিথ্যে নয়। আসাদকে অনুসরণ করলাম। ছোট একটা ঘরে বসার ব্যবস্থা করেছে। প্লাস্টিকের তৈরি চেয়ার এবং সামনে টেবিল। পাশে একটা টেবিল ফ্যান। মৃদু বাতাসে ঘরটা ঠান্ডায় ভরে উঠেছে। তার সাথে ভরে উঠেছে এই ছোট ঘরের আতিথীয়তা। এটা আমার জীবনের বিরল অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ছোট জীর্ণকুঠির। তবে তাকে এ পরিবেশে বেমানান। চেহারায় ফুটে উঠেছে মমতাময়ী এক নারীর প্রতিকৃতি। মার্জিত এবং শিক্ষিত বলে মনে হলো। বসতেই পরিচিত হলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। দীর্ঘ বছর পর বেড়াতে এলাম বন্ধুর বাড়ীতে। কিন্তু এ কি! কোথায় নিয়ে এলো। এখানে এসে খুব একটা অস্বস্থিবোধ করছি তা নয়। এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। দারিদ্রের ছাপ থাকলেও রয়েছে বুনিয়াদী সংস্কৃতির ছাপ। তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করলো। যেটা আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই পরিবারের দুটো ঘর। আমরা বাইরে ঘরে বসেছি। রাতে হয়ত এখানে কেউ ঘুমায়। প্রায় পনের মিনিট কেটে গেল।

আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম

হঠাৎ নায়ক সুলভ চেহারা একজন লোক এসে আদাব দিলো। প্রতি উত্তরে আদাব দিলাম। ভদ্র লোকের হাঁটা দেখে মনে হলো তার ডান পা একটু ছোট। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। আমার চোখে সে একজন সুপুরুষ। উজ্জ্বল গায়ের রঙ। লম্বা ছয় ফুটের মত। সব মিলে সে একজন নায়ক। এত সময় ধরে আসাদ মেয়েটির সাথে কি নিয়ে যেন আলোচনায় ব্যস্ত। লোকটা যে এই বাড়ী কর্তা ভাবেই বুঝে নিলাম। আসাদ পরিচয় করিয়ে দিলো। নাম প্রদীপ আর মেয়েটির নাম দীপ্তি। আর তাদের একমাত্র কন্যার নাম আলো। অভাবী হতে পারে আলোয় ভরা এদের সংসার। আমার এখন সংশয় কাটেনি। কেন এখানে আগমনের হেতু? কি উদ্দেশ্য? সে যাইহোক। লোকটার চেহারার দিকে আবার দৃষ্টিপাত করলাম। মন দিয়ে দেখলাম। পুরুষ মানুষের চেহারা এত সুন্দর হয় তাও আবার এই অজপাড়া গাঁয়ে নিম্নজাতের এক হিন্দুর ঘরে। আসাদ জানে এর গুরু রহস্য।

বেলা প্রায় বারটা বাজে। সারারাত জাগা। একটু ঘুমানো প্রয়োজন। মাস্টার মানুষ আয়াসে শরীর। আসাদ এবার তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললো,

  • দোস্ত, কিছু মনে করিস না। এরা আমার আপন জন। তোকে না  জানিয়ে এখানে এনেছি। এই যে দুজন দম্পতি তোর সামনে দেখছিস। এদের অতীত বড়ই নির্মম। আর এই এলাকা এ রকম ছিল না। বলতে পারিস আমার সমাজ কল্যাণ অধ্যয়নে হলেও এদের অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন করতে পেরেছি। সরকারী সাহায্য তো পেয়ে থাকি। এদের একটা সমবায় করে দিয়েছি। কিন্তু ঘটনার পিছনে ঘটনা থাকে। সেটা বলতেই তোকে এদের মাঝে এনেছি। আজ দুপুরে এদের সাথে ভোজ হবে। তবে নিরামিশ।

আবার চা দিলো। দারুণ স্বাদের চা। ঘটনা জানার জন্য আগ্রহে আছি। আসাদ শুরু করলো। যাকে দেখছো এর নাম প্রদীপ। ছোট সময় বাবা মারা যায়। রেখে যায় ছোট দুটো সন্তান আর বিধবা স্ত্রী। অভাবের সংসার। প্রায়  উপোস থাকতে হয়।  প্রদীপের বয়স আর কত হবে এই বার-তের। ছেলে হলে কি হবে চোখে ধরার মত চেহারা। সৃষ্টিকর্তা ভুল করে পুরুষ মানুষ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আবার পাঠিয়েছেন দিনমজুরীর বাড়ীতে। এখানেও ভাগ্যের লীলা খেলা। অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে পড়লো।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

পাশের গ্রামে যোগেন বাবু আর মানিক মৃধা তৈরি করলো যাত্রাদল। নাম ‘আনন্দময়ী অপেরা যাত্রা দল’। বাপ-দাদার সম্পত্তির বিনিময়ে এই যাত্রা দল গঠন করলো। নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নারী কোথায় পাবে। শকুনি চোখ পড়লো প্রদীপের দিকে। ব্যস। শুরু হলো। প্রদীপকে  নাচ-গান আর অভিনয়ে তালিম দেয়া হলো। প্রদীপ রাতারাতি তারকা হয়ে গেল। নাম হয়ে গেলে ‘দীপ্তি’। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু প্রতি রাতে পারিশ্রমিক পাঁচশত টাকা। পরে হয়ত বেড়েছিল। দিন তো ভাই চলছে ভালই কিন্তু ভাগ্য বিধাতা মনে মনে হাসছে। প্রেম হতে আরম্ভ করে শারীরিক নির্যাতন কোনটাই বাদ যায়নি প্রদীপের। বয়স তো আর কার অপেক্ষা করে না। এক নাগারে দশ বছর অভিনয় করে চলেছে। কিন্তু দুটো বেলা খাবার ছাড়া ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি এই পরিবারে। যাত্রাদলের মালিক বড় লোক হয়েছে এবং খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছে। এখন নারীর ভূমিকায় নারী অভিনেত্রী পেয়েছে। প্রদীপের ভাগ্যে প্রদীপ নিবু নিবু প্রায়। আর এরই মধ্যে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা।

তখন গরমকাল, এসএসসি পরীক্ষা চলছে। দীপ্তি আমাদের স্কুল এন্ড কলেজ হতে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সীট পড়েছে উপজেলা শহরে একটা স্কুলে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষা কেন্দ্র হতে আধা ঘন্টা সময় লাগে মেসে ফিরতে। দীপ্তিসহ বেশ ক’জন ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা শেষে মেসের দিকে যাচ্ছে। পাঁচটায় পরীক্ষা শেষে  বের হতে আর আধা ঘন্টা সময় লাগে। প্রায় ছয়টা বাজে। এক সাথে দল বেধে হাঁটছে। পথের দু’ধারে ঘন জঞ্জল। সাবধানে পথ চলতে হয়। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ে একটা মানুষের দেহ। উপুর হয়ে পড়ে আছে। সবাই অবাক, এ সময়ে এখানে এভাবে মানুষ পড়ে আছে। কি করা যায় কাছে কেউ নেই। দীপ্তি খুব সাহসী মেয়ে। সে কাছে গিয়ে দেখেই চিনতে পেরেছিল এটা প্রদীপ। কেউ প্রদীপকে মেরে এখানে ফেলে রেখে গেছে। অনেক কষ্টে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে  ভর্তি করে দেয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর এখন সে সুস্থ। কিন্তু নায়ক হওয়ার সখ চিরদিনের জন্য বন্ধ। মারে ডান পা ভেঙ্গে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন বাক্সবন্দি প্রেম
  • স্যার, আপনি না থাকলে প্রদীপকে বাঁচানো সম্ভবপর হতো না। আর আপনার জন্য আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি।
  • দীপ্তি, এটা তোমার ভালবাসার অবদান। প্রদীপ আমাকে বলেছে তুমি ওকে পাগলের মত ভালবাসতে। আর প্রদীপ বিভোর হয়ে থাকতো কেমন করে নায়ক হওয়া যায়। ওর অজান্তেই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিল একজন। কুঁড়ে ঘরে শুয়ে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন।

প্রদীপের দিকে চেয়ে দেখি সে মিট মিট করে হাসছে। হাসিটা আসলেই আমাদের সময়ের উত্তম কুমারের মত। ভাবছি এই প্রদীপ যদি কোন মধ্যবিত্ত হিন্দু ঘরে জন্মগ্রহণ করতো তাহলে কি হতো। নায়ক তো বটেই সমাজে নামীদামী কেউ হতে পারত। গোবরে পদ্ম ফোটে বটে কিন্তু অযত্নে অকালে ঝরে যায়। প্রদীপদের এমনই ভাগ্য। জানতে চাইলাম,

  • সিনেমার শেষ দৃশ্য।
  • শেষ দৃশ্য আবার কি? প্রদীপের বাড়ীর করুন অবস্থা। আবার তাকে রমজান চাচা বানিয়ে দিলাম। আমাদের বাজারে তেরি করে দেয়া হলো দোকান। পুঁজি ব্যবস্থা হলো। এখন বেশ চলছে। গঙ্গার জল অনেক দূর গড়েছে। দীপ্তি এইচএসসি শেষ করেছে। প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পেয়েছে। দেরী না করে মন্দিরে বিয়েটা শেষ করা হলো।

এক পর্যায়ে দেখলাম ঘরের ভেতরে বাতাস কেমন যেন ভারি হয়ে উঠেছে। এক পাশে বসা সাদা কাপড় পরিহিতা দুজন বিধবা মহিলা তারা মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাদের কান্নায় ছোট ঘরটি নিস্তব্ধ। মনে হলো গভীরে কোথায় যেন পুঞ্জিভূত দুঃখ লুকিয়ে আছে। কি করা যায়। আমি এদের অতিথি। এখন কর্তব্য আমার। তাই, সময় নষ্ট না করে বললাম,

  • আমি কিন্তু গান পছন্দ করি।

আমার কথা শুনে সবাই নড়েচড়ে বসলো। দু’জন মহিলার মধ্যে বয়স্ক মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

  • আপনি আমাদের নতুন অতিথি। অতিথি আমাদের কাছে দেবতা। দেবতার কাছে কিছু গোপন করতে হয় না। তাহলে আমাদের অকল্যাণ হবে। এই যে আমাদের ছোট পাড়াটা দেখছেন। আগে এ রকম ছিল না। আমরা খুবই গরীব ছিলাম। ঈশ্বর তাঁর দেবতাকে পাঠিয়েছেন আমাদের মুক্ত করার জন্য। তিনি আসাদ দেবতা। তিনি আমাদের কাছে দেবতা। তার কল্যাণে আমাদের ছোট এই পাড়ায় সূর্যের আলো লেগেছে। আজ আর এক দেবতা আমাদের কুঁড়ে ঘরে।
আরও পড়ুন গল্প খোয়ার

মহিলার কথা শুনে আমি তো অবাক। এরা মানুষকে এত বিশ্বাস করে। আসাদ আসলেই তুমি মহান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পেরেছে। তুমি তোমার তুলনা।

ইতোমধ্যে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেবারে নিরামিষ। অসাধারণ রান্না। পেট ভরে খেলাম। সাথে হাতে তেরি মিষ্টি। আধা ঘন্টার মধ্যে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার বসা হলো। রবীন্দ্র ঠাকুরের দুটো গান গেয়ে শোনালো দীপ্তি। অপূর্ব কণ্ঠ। মনের ভেতরে আবার সেই বিষাদ জেগে উঠলো। এমন প্রতিভা কেন জন্মায় একটা অজোপাড়া গায়ে, বিত্তহীন গরীব ঘরে। জন্ম কি এদের আজন্ম পাপ? এবার বিদায় পালা। দীপ্তি একটু সময় চাইল। সে পাশের ঘরে ঢুকলো। পাঁচ মিনিট পর বের হয়ে এলো। তার হাতে মনে হলো কিছু ছবি। আমার হাতে দিয়ে বললো,

  • স্যার, দেখুন তো ছবিগুলোর মধ্যে কোনো ছবি এর আগে কখনো কি দেখেছেন?

ছবিগুলো হাতে নিলাম। ছয়খানা ছবি। বিভিন্ন পোজের ছবি। এ যে পরমা সুন্দরী। এত সুন্দর কোন মানুষের চেহারা হতে পারে! শুধু চেহারাই নয় ভূবন ভুলানো হাসি। হঠাৎ শেষের ছবির দিকে চোখ পড়লো। আরে! এই তো সেই ছবি যা আসাদ পাঠিয়েছিল। কিন্তু! মাথার ভেতর ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি আসাদ আর দীপ্তি মনের সুখে হাসছে।

  • দোস্ত, কি ভাবতেছো? এই সেই ছবি যা তোমাকে পাঠিয়েছিলাম বিশ বছর আগে।
  • কিন্তু?

পাশে বসা দীপ্তি বললো,

  • স্যার, এ সবগুলো ছবি প্রদীপের। ওর বয়স যখন বিশের নিচে।

আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি। ত্রিশ বছর বয়সী প্রদীপের মুখের দিকে। চেহারা অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে। সেই আঘাতের পর হতে শরীর ভাল হচ্ছে না। তবু তারা ভাল আছে।

বিদায় নেয়ার সময় আসাদ আর আমাকে তারা মাঝখানে রেখে গোল হয়ে দাঁড়ালো। তাদের কায়দায় প্রণাম করলো। আর কণ্ঠে ভেসে উঠলো-‘দেবতার জয় হোক’।

আরও পড়ুন দীপ্তিদের দেবতা গল্পের-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

দীপ্তিদের দেবতা (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!