তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ি
তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ি
তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের তাঁতিবন্দ গ্রামে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। উক্ত জমিদার বাড়িতে এই জমিদার বংশের তৈরি করা মঠ ‘বিজয় বাবুর মঠ’ নামে জনসাধারণের কাছে বেশ পরিচিত।
উপেন্দ্রনারায়ণ এই জমিদার বংশ ও জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হলেও মূলত জমিদার বিজয়গোবিন্দ চৌধুরী সময় জমিদার বাড়িতে বিশাল বিশাল সুন্দর কারুকার্যখচিত একাধিক অট্টালিকা তৈরি করা হয়। এছাড়াও তিনি কয়েকটি দিঘি ও দুইটি সুউচ্চ মঠ নির্মাণ করেন। তিনি প্রভাব-প্রতিপত্তিতে পাবনা জেলার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ভারতবর্ষের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) সময় বিজয়গোবিন্দ বৃটিশ সরকারকে সহায়তা দিয়েছিলেন বলে রাধারমণ সাহার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। এ ছাড়া এ অঞ্চলে এখনো দানশীলতা ও সৌখিন জমিদার হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। তার সময়ে জাকজমকের সঙ্গে দূর্গা-উৎসব পালিত হতো। এ উপলক্ষ্যে হাতির নাচ হতো। বিনোদনের জন্য কলকাতা থেকে নর্তকীদেরও নিয়ে আসা হতো।
তাঁতিবন্দের চৌধুরী জমিদার বংশের লোকদের বহুবিবাহের ফলে বংশধরদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ-বিরোধ সৃষ্টি হয়। কালের পরিক্রমায় তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপ হলে তাদের অনেকেই ভারতে চলে যান। অনেকেই সম্পত্তি বিক্রয় করে দেন স্থানীয় জোতদারদের কাছে। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের আরেক দফা ভারতে স্থানান্তর ঘটে। তাঁতিবন্দে এখন কোনো জমিদারের উত্তরসূরী বসবাস করেন না। বর্তমানে তাঁতিবন্দ জমিদার বড়িটি লতা-পাতা আর ঝোড়-জঙ্গলে আচ্ছাদিত। চুন-সুরকির ঢালাইকৃত বিল্ডিঙের ছাদের প্লাস্টার জায়গা জায়গায় খসে পড়ছে আর ছাদের লোহার ও কাঠর বিমগুলো দূর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় খসে পড়ার উপক্রম। তবুও এসব (৫/৬টি ভগ্নপ্রায় একতলা বিল্ডিং, ২টি দ্বিতল ভবন, কালী মন্দিরের একটি মঠ) স্থাপনা ও ৩/৪টি বিশাল পুকুর কালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
আরও পড়ুন সুরেন বাবু
অভয়গোবিন্দ চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র তারকগোবিন্দ চৌধুরী ‘জমিদারি শিক্ষা’ ও ‘মহাজনী শিক্ষা’ নামে দুটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। তিনি পাবনা শহরে ‘শিল্প সঞ্জীবনী’ নামে একটি মোজা ও গেঞ্জির কারবার গড়ে তুলে উন্নতি লাভ করে ছিলেন। তাঁতিবন্দের জমিদার বাড়িতে ১৮৮৯ সালে তার নির্মিত দ্বিতল ভবনটি কালের সাক্ষী স্বরূপ এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তৎকালীন প্রায় সব জমিদারই কমবেশি অত্যাচারি ছিলেন। তারা একদিকে যেমন প্রজাদের শোষণ করতেন, অপরদিকে বিজাতীয়দের প্রতি ছিল ঘৃণা ও অবিচার। বিশেষ করে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে গরু কুরবানি দিতে পারত না। এমন কি তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পালকিতে চড়ে কিংবা জুতা পায়ে দিয়ে মুসলমান প্রজারা যেতে পারত না। এ বিষয়ে ‘চলনবিলের ইতিকথা’-এর লেখক এম এ হামিদ তার গ্রন্থে একটি সত্যঘটনা তুলে ধরেছেন। ঘটনাটি নিচে তুলে ধরা হলো: কিন্তু সরকার (জন্ম ১৮১৭ খ্রি.) পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার জাবরকোল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি একজন স্বচ্ছল গৃহস্থ ও আদর্শ সমাজসেবী ছিলেন। তৎকালে শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় তাঁর সমকক্ষ লোক খুব কমই ছিল। ইংরেজ কর্মচারী ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি বহুবার জোর প্রতিবাদ করেছেন। একবার তিনি পালকিতে চড়ে তাঁতিবন্দের জমিদার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তৎকালে পালকি তো দূরের কথা, হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে দিয়ে যাওয়া যেত না; গেলে ‘জুতাসেলামি’ দিতে হতো।
আরও পড়ুন দুলাইয়ের মুসলিম জমিদার আজিম উদ্দিন চৌধুরী
এমন পরিস্থিতে একজন সাধারণ মুসলমানের পক্ষে পালকিতে চড়ে জমিদার বাড়িতে যাওয়া কিরূপ সাহসের কাজ তা সহজেই অনুমেয়। এই অপরাধের জন্য তাঁর গর্দান যেতে পারে-এ কথা জানা সত্ত্বেও মুসলমানরা যে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি তা বুঝানোর জন্যেই তিনি পালকিতে চড়ে তাঁতিবন্দের জমিদার বাড়িতে যান। জমিদার বাড়ির মহিলারা পুরোহিত ঠাকুর এসেছে মনে করে পুষ্পমাল্য নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে আসল কিন্তু পুরোহিতের বদলে জমিদারের পরম শত্রু অবাঞ্ছিত মুসলমান কিনু সরকারকে পালকিতে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। জমিদার সব বৃত্তান্ত শুনে কিনু সরকারের গর্দান নেওয়ার জন্যে হুকুম দিলেন। তেজস্বী বীর কিনু সরকার সিংহগর্জনে প্রতিবাদ জানালেন; জমিদারকে বললেন, ‘আপনার কোন শাস্ত্রে আছে মুসলমান পালকিতে আসলে তাঁর গর্দান নিতে হবে?’ কিনু সরকারের সাহস ও ব্যক্তিত্বের কাছে জমিদারের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।
জমিদার বাড়ির প্রতিটি স্থাপনাই এখন অযত্ন ও অবেহলায় পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে জমিদার বংশধরদের তৈরি করা দুইটি দৃষ্টিনন্দন মঠ এখন পর্যটনমুখী মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। যেগুলো দেখার জন্য প্রতিনিয়ত মানুষরা এখানে ভিড় জমান।
তথ্যসূত্র:
১। সুজানগরের ইতিহাস ; লেখক: ড. আশরাফ পিন্টু
২। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা
আরও পড়ুন-
জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী
বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর বংশ পরিচয়
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
তাঁতিবন্দ জমিদার বাড়ি