ড.-অশোক-কুমার-বাগচী-২
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  চিকিৎসক,  তাঁতিবন্দ (গ্রাম),  তাঁতিবন্ধ,  লেখক পরিচিতি,  সাহিত্য

ডা. অশোক কুমার বাগচী

ডা. অশোক কুমার বাগচী উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের এক অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরোসার্জন। তিনিই সর্বপ্রথম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসুস্থ জীবন সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দাখিল করেন।

জন্ম: ডা. অশোক কুমার বাগচীর পৈত্রিক নিবাস পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত তাঁতিবন্দ গ্রামে। তিনি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে নভেম্বর রংপুরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক জীবন: ডা. বাগচীর পিতার নাম দ্বিজদাস বাগচি। তাঁর জন্মের সময় পিতা দ্বিজদাস বাগচী পাবনা শহরের ‘বাগচি ফার্মেসি’তে ডাক্তারি করতেন। পিতা ও পিতামহ উভয়েই সেকালের নাম করা ডাক্তার ছিলেন।

শিক্ষা জীবন: ডা. বাগচী ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা জি.সি আইতে ভর্তি হন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতায় আশুতোষ কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের কলকাতায় বোমা ফেলার আতঙ্কে পাবনা এসে ভর্তি হন সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। এরপর কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, আরজি কর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারী পাশ করেন। সব কয়টি বিষয়ে প্রথম হন। ১৯টি মেডেল এবং ডাক্তারিতে স্কলারশীপ নিয়ে নিউরো সার্জারি পড়ার জন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যান। ভিয়েনায় অসাধারণ রেজাল্ট করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাস্টারশীপ পাশ করেন। এ জন্য তাকে ভিয়েনায় দেখা হয় ‘ম্যাগনা কাম লাউডে সার্টিফিকেট’। অচিরেই তিনি জগৎবিখ্যাত নিউরোসার্জন হয়ে ওঠেন।  ইউরোপের  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় ছাত্র। ইউএসএ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

আরও পড়ুন কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক আনন্দ বাগচী

কাজী নজরুল ইসলাম ও ডা. বাগচী: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.) আকস্মিকভাবে বাকরুদ্ধ হন ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জুলাই। সুদীর্ঘ ৩৪টি বছর ধরে (১৯৪২-১৯৭৬ খ্রি.) আয়ত নয়নে কবি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। কোনো কথা বলতে পারেন নাই। ফুলের জলসায় চিরকালের মতই কবি একেবারে নীরব হয়ে গেলেন। নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক হচ্ছে। ভবিষ্যতে হবে এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু নজরুলের অসুস্থ জীবনের গোড়ার কথা সম্পর্কে ডা. অশোক বাগচী যে কথা বলেছেন তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ডা. বাগচীর অসুস্থ নজরুল ইসলাম সম্পর্কের কথা এখানে তাঁর ভাষায় হুবহু তুলে ধরা হল:

‘‘নজরুলের অসুস্থতার লক্ষণ যখন প্রথম প্রকাশ পায় তখন বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় নাই। বিশেষ করে তার স্ত্রী প্রমিলা নজরুল যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন (১৯৩৭ খ্রি.) তখন দেখা যায় নজরুল হঠাৎ ‘কালী সাধনা’ শুরু করেছেন। অনেকেই এটাকে ধরে নেন তার মানসিক বৈকল্য হিসাবে। গেরুয়া পোশাক আর মাথায় গেরুয়া টুপি ছিল তার তখনকার পরিধেয় বস্ত্র।সেই সময় তিনি মাঝে মাঝে গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান গাওয়ার সময় একটু আধটু বেসুরো হতে থাকেন। অবশ্য ধরিয়ে দিলে ভুল বোঝেন এবং সংশোধনের চেষ্টাও করেন। কিন্তু পুরোপুরি অসুস্থ হবার পর (১৯৪২ খ্রি.) তিনি সব কিছুর বাইরে চলে যান। কোনো কিছুই আর ঠিকমত ধরে রাখতে পারেন না। এরূপ লক্ষণ তার সে সময় প্রকাশ পায়।”

ডা. বাগচী আরো বলেছেন, “বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ ও বাকশক্তি রুদ্ধ হবার পর হতে কোনো চশমাধারী লোককে কখনই সহ্য করতে পারতেন না। চমশাধারী লোক তার সম্মুখে উপস্থিত হলে তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত ও অস্বস্তি বোধ করতেন।’

আরও পড়ুন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার

ডা. বাগচীর ধারণা নিশ্চয়ই কোনো চশমাধারী লোকই সে সময় তার বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়েছিল। যা তার মস্তিষ্কের মধ্যে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে দেয়। ডা. বাগচী নজরুলের অসুস্থতার অন্য সমস্ত কারণকে অস্বীকার করে একথা বলেছেন যে, কবির ‘স্নায়ুবিক বৈকল্য’ সম্পর্কে ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের চিকিৎসার মতামতটাই যথার্থ ছিলো বলে তিনি মনে করেন। তখন তাকে ভারতের রাচী ও বিহারের মধুপুরে পাঠানো এবং অন্যান্য মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ তার অসুস্থতাকে বাড়তেই সাহায্য করেছে বলে তিনি মনে করেন।

ড.-অশোক-কুমার-বাগচী
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ডা. বাগচী কলকাতায় অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তন করেন এবং নিবিড়ভাবে কবি পরিবারের সাহচর্যে আসেন। এর এক বছর পরই ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কবি নজরুল ইসলামকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় নিয়ে যান। নজরুলের মস্তিষ্কের প্রথম আধুনিক পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনার যে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসকবৃন্দ যৌথভাবে নজরুলের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ভিয়েনার বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট স্যার রাশেল ব্রেইন, নিউরো সার্জন ডা. ওয়েলি ম্যাকিসক এবং বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডা. উইলিয়াম সার্জেন্ট। ডা. বাগচীও ছিলেন যৌথভাবে তাদের সঙ্গে। ঐ পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে নজরুল ইসলামের ব্যাধি মানসিক বৈকল্য নয়।

আরও পড়ুন কবি, সাহিত্যিক ও গবেষক বিমল কুণ্ডু

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বাকশক্তি হারান। এরপর থেকে তার যত রকমের চিকিৎসা করা হয়েছে সব চিকিৎসাই ছিল ভুল ও ব্যর্থ। একমাত্র ডা. বিধান চন্দ্র রায়ই আশঙ্কা করেছিলেন নজরুল ‘স্নায়ু বৈকল্যে’ আক্রান্ত হয়েছেন যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আল-ঝেইমার্স। কিন্তু নজরুলের জন্য সে সময় গঠিত মেডিকেল বোর্ড ডা. বিধান চন্দ্রের সুপারিশ কোনোক্রমেই গ্রহণ করেন নাই। ডা. বাগচীর মতে, ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের মধ্যে যখন প্রাথমিকভাবে এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়ে তখন সেই সময়ে যদি তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হত, তাহলে নজরুল ইসলামের সম্ভবত এই করুণ পরিণতি হতো না। ভিয়েনার ডাক্তারগণ যৌথভাবে মত প্রকাশ করেন নজরুলের চিকিৎসার আর সময় নেই। অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে।

সঙ্গীত ও সাহিত্য: ডা. বাগচীর অনুরাগ ছিল সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চায়। তাঁর স্নায়ুশল্য শাস্ত্রীয় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। দেশি ও বিদেশি ২৬টি সংস্থার সভ্য ছিলেন। তিনি ভারতীয় স্নায়ুস্বাস্থ্য সংস্থার সভাপতি এবং ভারতীয় স্নায়ুতত্ত্বশাস্ত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

তিনি কবিতাও লিখতেন। পাশ্চাত্য সংগীত কোষও রচনা করেছেন।

কাব্যগ্রন্থ:

  • ছবি ও কলম (১৯৮৮ খ্রি.)
  • সম্পাদক সমীপেষু (১৯৯৫ খ্রি.)

অনুবাদগ্রন্থ:

  • বিশ্বসাহিত্যের চিকিৎসক (১৯৯৩ খ্রি.)

জীবনীগ্রন্থ:

  • পিছু ডাকে
  • সোনার খাঁচা

এই স্মৃতিগ্রন্থ দু’টিতে আছে পাবনা শহরের ছেলে বেলা থেকে সল্টলেকের বৃদ্ধাবস্থার কথা।

অন্যান্য:

  • টেলস ফ্রম স্মল টাউন

 

ডা. অশোক বাগচীর পাবনার মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়।

মৃত্যু: এই প্রতিভাবান মানুষটি ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

তথ্যসূত্র:

  • সুজানগরের ইতিহাস, লেখক: ড. আশরাফ পিন্টু
  • প্রিয়.কম

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ডা. অশোক কুমার বাগচী

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!