জমিদার আজিম চৌধুরী
জমিদার আজিম চৌধুরী
যুগের পরিবর্তনে এবং কালের পরিক্রমায় মানুষের অনেক কর্মযজ্ঞ এবং স্মৃতি চিহ্নই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু শুধু নিশ্চিহ্ন হয় না তার কর্মক্ষেত্রের ঐতিহ্য মন্ডিত ইতিহাস। ইতিহাস তার নিজের গতিতেই চলে। ইতিহাস কখনও মুছে যায় না। এমনকি শত চেষ্টা করেও ইতিহাসের অমোঘ সত্য ঘটনাবলী এবং প্রচার-প্রচারণাকে চাপা রাখা যায় না। আর তাইতো পাবনাবাসী যুগ যুগ ধরে স্মৃতিচারিত করছে জমিদার আজিম উদ্দিন চৌধুরীর নাম ও তাঁর কর্মযজ্ঞ।
মুসলিম জমিদারদের মধ্যে প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন পাবনার সুজানগর উপজেলার দুলাই গ্রামের আজিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর প্রকৃত নাম ফখরউদ্দিন আহলে আহসান আজিম চৌধুরী।
জন্ম: আনুমানিক আড়াইশ বছর আগে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার দুলাই ইউনিয়নের দুলাই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আজিম উদ্দিন চৌধুরীর জন্মগ্রহণ করেন।
আজিম চৌধুরীর সঠিক জন্মতারিখ লিখিত আকারে পাওয়া যায় না। তার পিতা রহিমুদ্দিন সরকার (পরে চৌধুরী) ১৮০২ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি এখনো জমিদার বাড়িতে বিদ্যমান। আজিম চৌধুরীর উত্তরসূরী আহসানজান চৌধুরীর মতে, মসজিদটির নির্মাণের সময় আজিম চৌধুরীর বয়স ছিল ১০/১২ বছর। তিনি প্রায় ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সেই মোতাবেক আজিম চৌধুরী আনুমানিক ১৭৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৮০ সালে মারা যান। এছাড়া আজিম চৌধুরীকে নিয়ে ১২৯৮ হিজরিতে (১৮৭৭খ্রি.) রচিত হাজি বদরউদ্দিনের “আজিম চৌধুরী” নামক পুস্তিকাতে লেখকের সাক্ষাতের কথা পাওয়া যায়-
“আমি ও পটু মিয়া চাচা বাড়ি থাকি।
মছজেদে পড়িয়া কত হইয়াছি সুখী।।
লতিফুল্লা মিয়া সঙ্গে থাকিয়া হামেসা ।
চৌধুরী আজিমের কত পাইয়াছি ভালোবাসা।”
এ কবিতার উদ্ধৃতি থেকেও প্রমাণিত হয় আজিম চৌধুরী ১৮৭৭ সালেও জীবিত ছিলেন।
আরও পড়ুন সুরেন বাবু
জমিদারী: জমিদার আজিম চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ থেকে পাবনায় আসেন। তার পিতা রহিম উদ্দিন মুন্সি আরবি-ফারসিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি নাটোররাজের অফিসে নকল-নবীশের কাজ করতেন। কাজের দক্ষতার জন্য তিনি সেখান থেকে ‘মুখি’ খেতাব লাভ করেন। তিনি পাবনার দুলাই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার একমাত্র পুত্র আজিম চৌধুরীর আমলেই জমিদারির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই খ্যাতিমান পুরুষ তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে তৎকালে ওই এলকায় জমিদারিত্ব করার পাশাপাশি দুলাইতে ২/৩টি নীলকুঠি স্থাপন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল জমিদারির আয়ের সাথে নীলকুঠির আয় যোগ হলে এক সময় তিনি সীমাহীন অর্থ-বিত্তের মালিক হন। আর মূলত সেই সময় থেকেই তার জমিদারিত্বের উত্থান এবং সুনাম পাবনাসহ আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
আজিম চৌধুরী খুবই শৌখিন ছিলেন। তিনি দুলাই নিভৃত পল্লীতে চারতলা বিশিষ্ট একাধিক দৃষ্টিনন্দন বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেন। এ ভবনগুলো বহু কক্ষ ও বহুদুয়ারী বিশিষ্ট। ৪০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাড়িটিতে ছিল ১১টি নিরাপত্তা গেট। প্রথম গেটে নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ২টি হাতি থাকত। সামগ্রিক নিরাপত্তায় দুটি কামানও বসানো ছিল। অন্য জমিদারদের আক্রমণের নিরাপত্তা সুরক্ষায় বাড়ির চতুর্দিকে বিশাল দীঘি কাটা হয়। বাড়িতে দেশি-বিদেশি প্রচুর গাছের বাগান করা হয়। বাড়িটির মূলভবন, মসজিদ, পুকুর, হাতিশাল, ঘোড়াশাল, কাঁচারিবাড়িসহ প্রাসাদের আয়তন ছিল প্রায় ৭শ বিঘা। বর্তমানে জমিদার বাড়ির প্রাচীন মসজিদ ও পুকুরগুলো প্রায় অক্ষত থাকলেও জমিদার বাড়ির ভবনগুলো ভগ্নদশায় পরিণত।
আরও পড়ুন তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদ
আশেপাশের জমিদারদের মধ্যে আজিম চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী, ধার্মিক ও দয়ালু। তার জমিদারি আমলে এলাকায় অত্যন্ত কঠোর শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। প্রজাগণ যথাসময়ে খাজনা প্রদানসহ জমিদার আজিম চৌধুরী ঘোষিত যে কোনো নিয়মনীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করে চলত। তিনি কঠোরহস্তে তার জমিদারি এলাকার সকল প্রকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে তার উদারতা এবং মহত্ত্বেরও তুলনা ছিল না। কোনো প্রজা যদি অভাব অনটনের কারণে কোনো বছর খাজনা পরিশোধ করতে না পারত তাহলে তিনি তার বাৎসরিক সমুদয় খাজনা মওকুফ করে দিতেন। তাছাড়া তিনি মুসলিম জমিদার হলেও সর্বদা এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে চলতেন। শুধু তাই না সে সময় তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে পূজা-পার্বণে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বৎসর জমিদারি দরবারের পক্ষ থেকে দুলাই বাজারে শারদীয় দুর্গোৎসবেরও আয়োজন করতেন।
পাবনা জেলার প্রথম ইতিহাস রচয়িতা রাধারমণ সাহা তার গ্রন্থে লিখেছেন, “যদি বৎসর মধ্যে প্রজাগণ সম্পূর্ণ খাজনা পরিশোধ করিতে অসমর্থ হইত তাহা হইলে তাহারা খাজনা আদায়ে অক্ষম বলিয়া বৎসরের অবশিষ্ট বাকি খাজনাদি সম্পূর্ণ মাফ পাইত।”
দানশীল: আজিম চৌধুরী নিজে অনেক সম্পত্তি দান করেন। তার জমির উপরই আজও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হাজি বদরউদ্দিনের “আজিম চৌধুরী” পুস্তিকায় আজিম চৌধুরীর প্রজা হিতৈষিতা ও দানশীলতার কথাও জানা যায়-
“চৌধুরী ফখরউদ্দিন নামটি যাহার।
ওরফে আজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রচার।।
বিশ্বাস ও ভক্তি মূলে উপরে তোমার।
প্রবল প্রতাপে থাকি জগৎ মাঝার।।
প্রজা বন্ধু দয়াবান হইয়া আজিম।
দানধ্যানে পূণ্য লভিতে তাজিম।।
ফিটিং আদি টমটমে চড়িছে যখন।
সিকি ও আধুলি পয়সা করেছে জোটন।।
সামনে অর্থের তোড়া রাখি সাজাইয়া।
গরিবে করিত দান গাড়ি আহরিয়া।।
শুনিয়া গরিব-দুঃখী আনন্দে মাতিয়া।
সড়কের দুইধারে রহিত সাজিয়া।।
মুখেতে সুখের বোল জয় জয় রব।
আসিছেন মহাপ্রভু দুঃখীর বান্ধব।।
আসিবে কাঙাল-পালক আজিম এখন।
ভিক্ষা দিবে মনমতো করি বরিষণ।।…
আজিম চৌধুরীর দাতব্য চিকিৎসালয়ের কথা W. W Hunter (BA LLD) সাহেবের “A Statistical Account of Bengal (1876) গ্রন্থে এভাবে লিপিবদ্ধ আছে- “It is entirely supported by the Local land ownerMaulvi Azim uddin Chudhury.”
আরও পড়ুন উলাট সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসা
মৃত্যু: আজিম চৌধুরীর ইংরেজদের সাথে তেমন সুসম্পর্ক ছিল না। এর মূলকারণ তিনি সিপাহী বিদ্রোহের সময় (১৮৫৭ খ্রি.) বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য করেন। অথচ তার সমসাময়িক পার্শ্ববর্তী তাঁতিবন্দের জমিদার বিজয়গোবিন্দ বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সহযোগিতা করে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হন। ফলে বিজয়গোবিন্দের সঙ্গে আজিম চৌধুরীর বন্ধুত্বের ফাটল ধরে। এ সুযোগে ইংরেজরা আজিম চৌধুরীকে নানাভাবে উৎপীড়ন করেন। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে খাজনা না দেয়ার কারণে ইংরেজরা তাকে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দমনের জন্য সশস্ত্রবাহিনী পাঠায়। এ সময় আজিম চৌধুরীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হলে তিনি পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে প্রাসাদের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পালিয়ে বজরায় চড়ে কলকাতার নিকটবর্তী ফ্রেন্স চন্দননগরে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৫/২০ বছর অতিবাহিত করে পাবনা শহরে বাকি জীবন কাটান। তার কবর এখনও পাবনা শহরের ফায়ার ব্রিগেডের পাশে নিজবাড়িতে সুরক্ষিত আছে।
তথ্যসূত্র:
১। সুজানগরের ইতিহাস ; লেখক: ড. আশরাফ পিন্টু
২। দৈনিক ইত্তেফাক
আরও পড়ুন আজিম উদ্দিন চৌধুরী-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
জমিদার আজিম চৌধুরী