জমিদার-আজিম-চৌধুরীর-বংশ-পরিচয়
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  জমিদার,  দুলাই,  দুলাই (গ্রাম)

জমিদার আজিম চৌধুরীর বংশ পরিচয়

জমিদার আজিম চৌধুরীর বংশ পরিচয়:

 

আজিম চৌধুরীর পিতামহ শরফুদ্দিন সরকার আঠারো শতকে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ থেকে এদেশে আসেন। ধারণা করা হয় ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের সাথে তিনি এদেশে এসে পাবনা জেলার সুজানগরের দুলাইতে (আহ্লাদিপুর গ্রামে) বসতি স্থাপন করেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তার ছেলে রহিমুদ্দিন (আনুমানিক ১৭২২-১৮১৫ খ্রি.) সরকার আরবি-ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষাও জানতেন। মেধাবী রহিমুদ্দিন নাটোরের রাজবাড়িতে মুহুরিগিরি ও নকলনবিশের কাজে দক্ষতা দেখিয়ে ‘মুন্সি’ উপাধি লাভ করেন। তিনি উত্তরোত্তর কাজে দক্ষতার জন্য পেঙ্কার পদে উন্নীত হয়। এ সময় তিনি প্রভুত ক্ষমতা ও অর্থ অর্জন করেন। তিনি ও তাঁতিবন্দের জমিদার বংশর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী একই সময়ে নাটোর কালেক্টরি অফিসে যথাক্রমে পেস্কার ও সেরেস্তাদার পদে কাজ করতেন। এ সময় রহিমুদ্দিন মুন্সি নিলামে সম্পত্তি ক্রয় করে জমিদারি প্রাপ্ত হন।

রহিমুদ্দিন  পাবনার দুলাই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার একমাত্র পুত্র আজিম চৌধুরীর (আনুমানিক ১৭৯০-১৮৮০ খ্রি.) আমলেই জমিদারির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই খ্যাতিমান পুরুষ তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে তৎকালে এই এলকায় জমিদারিত্ব করার পাশাপাশি দুলাইতে ২/৩টি নীলকুঠি স্থাপন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল জমিদারির আয়ের সাথে নীলকুঠির আয় যোগ হলে এক সময় তিনি সীমাহীন অর্থ বিত্তের মালিক হন। আর মূলত সেই সময় থেকেই তার জমিদারিত্বের উত্থান এবং সুনাম পাবনাসহ আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

আজিম চৌধুরীর স্ত্রী ছিলেন চার জন। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও মারা যান নিঃসন্তান অবস্থায়। তৃতীয় স্ত্রী সন্তানদানে অক্ষম মনে করে তিনি চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করেন। সৌভাগ্য ক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্ত্রীর গর্ভে কয়েক মাসের ব্যবধানে ভাগ্যক্রমে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাদের নাম আহমেদ জান চৌধুরী ও হায়দার জান চৌধুরী। আহমেদ জান চৌধুরী ও তার মা আজিম চৌধুরীর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করেন। আহমেদ জান চৌধুরী রহমত জান চৌধুরী নামে এক পুত্র রেখে যান কিন্তু ইসলামি আইন মতে তিনি আজিম চৌধুরীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।

আরও পড়ুন বিল গাজনার ইতিহাস

আহমেদ জান চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী এতিম রহমতজান চৌধুরীকে নিয়ে পিতৃগৃহ গোপালগঞ্জের খানপুরে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেন। জানা যায়, ঐ বিধবা কন্যা জমিদারের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন। জমিদারের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন নাতি রহমতজান চৌধুরী। মৃত্যুর সময় তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। ছেলেরা হলেন সাইদ (সৈয়দ) জান চৌধুরী, লতিফজান চৌধুরী ও মোহাম্মদ জান চৌধুরী। সাইদজান চৌধুরী বিয়ে করেন বরিশালের উলানিয়া জমিদার বাড়িতে। মোহাম্মদ জান চৌধুরী বিয়ে করেন বরিশালের দেউলি জমিদার বাড়িতে। আর লতিফজানের বিয়ে হয় পাবনার স্বীয় বংশে হোসেনজান চৌধুরীর মেয়ে কামরুন নেছার সাথে।

সাইদজান উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন; রেখে যান ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ে। তারা হলেন- সারওয়ারজান চৌধুরী, মহব্বতজান চৌধুরী (বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল ছিলেন, পরবর্তীতে মন্ত্রী হন), মাহমুদজান চৌধুরী, আমিনা খান (লন্ডন প্রবাসী), সুলতানা চৌধুরী, সালমা ভূঁইয়া (আমেরিকা প্রবাসী), রোকেয়া চৌধুরী ও জাহানারা চৌধুরী (ঢাকায় থাকেন)। লতিফ জান চৌধুরীর ৫ ছেলে ৩ মেয়ে। তারা হলেন-শওকতজান চৌধুরী, হায়াত জান চৌধুরী, দৌলতজান চৌধুরী, দাউদজান চৌধুরী, সউদজান চৌধুরী, জাহানারা চৌধুরী ও শাহনারা চৌধুরী। মোহাম্মদ জান চৌধুরীর ৬ জন ছেলে ৪ মেয়ে রওনক-উল-বায়াত গহর-এ-আজম (ফরিদপুরে বসবাস করছেন), এনাম মাশরাফি (কানাডা প্রবাসী), মিজানুল মওলা (আমেরিকা প্রবাসী), সিরাতুল মুস্তাকিম (কানাডা প্রবাসী), তসলিম জান চৌধুরী (আমেরিকা প্রবাসী), চৌধুরী আরজু করিম, ওয়ারজুফিল আকরাম (ফরিদপুরে বসবাস করছেন), ফেরদৌসি জামিলা (কানাডা প্রবাসী) ও জান্নাতি তাহেরা (ঢাকায় বসবাস করেন)।

আরও পড়ুন আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম

আজিম চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে হায়দারজান চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন ফরিদপুর জেলার পদনদীয়ার জমিদার সৈয়দ ফজলে কন্যা সৈয়দা শরিফুন নেছাকে। তিনি ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন লক্ষ্ণৌ শহরের এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় এক পরমা সুন্দরী। তার গর্ভে মুন্নুজান নামে এক কন্যার জন্ম হয়। কন্যাটি অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

হায়দারজান চৌধুরী প্রথম স্ত্রী শরিফুন নেছার গর্ভের ৩ ছেলে হলেন— হোসেনজান চৌধুরী, ফসিউদ্দিন চৌধুরী ও আব্দুল বাছেদ চৌধুরী। এই তিনভাই বাস করে গেছেন আজিম চৌধুরীর পাবনা শহরের দিলালপুরের বাড়িতে। হোসেন জান চৌধুরীর প্রথম পক্ষের ১ ছেলে; নাম আব্দুস সোহবান চৌধুরী। দ্বিতীয়পক্ষের ৫ জন ছেলে; তারা হলেন গোলাম হায়দার আবু দাউদ চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, গোলাম রহমান চৌধুরী, গোলাম কাদের চৌধুরী, গোলাম সোহবান চৌধুরী। তৃতীয় পক্ষেরও ৫ জন ছেলে; তারা হলেন- রওশনজান চৌধুরী, মহসিনজান চৌধুরী, সারওয়ারজান চৌধুরী, মাহবুবজান চৌধুরী, রফিক জান চৌধুরী। হায়দার জান চৌধুরীর ৬ মেয়ের নাম হলো— নুরুন্নাহার বেগম, জাহানারা আব্দুল্লাহ, কামরুন্নেসা চৌধুরানি, রিজিয়া বেগম ও দেলওয়ারা চৌধুরী (একজনের নাম পাওয়া যায়নি)।

আব্দুস সোহবান চৌধুরীর একমাত্র ছেলের নাম হায়বাতজান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন।

রওশনজান চৌধুরীর (১৯১৭-২০১১ খ্রি.) ৪ ছেলে ৪ মেয়ে তারা হলেন- আহসানজান চৌধুরী (মেরিন ইঞ্জিনিয়ার), আহমাদজান চৌধুরী, আসাদজান চৌধুরী, এরশাদজান চৌধুরী (অবসর প্রাপ্ত নেভির কমান্ডার), আফিফা জামান, আফসানা জামান, ফারহানা চৌধুরী ও নাজলী চৌধুরী। মহসিনজান চৌধুরীর ২ ছেলে ৩ মেয়ে রাজু চৌধুরী, আনোয়ার চৌধুরী, শামিম আরা চৌধুরী, নাসিম আরা চৌধুরী ও শাহিন আরা চৌধুরী। বর্তমানে রওশন জানের ছেলেমেয়েরা পাবনায় বসবাস করছেন এবং আজিম চৌধুরীর জমিদারির সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। সারওয়ার জান চৌধুরীর একমাত্র মেয়ের নাম নিনা চৌধুরী। মাহবুবজান চৌধুরীর ৩ ছেলে ১ মেয়ে: মোস্তাকজান চৌধুরী, আহমেদজান চৌধুরী, মইনজান চৌধুরী ও চৌধুরী মাহবুবা মমতাজ। রফিক জান চৌধুরীর ৩ ছেলে ২ মেয়ে। তারা হলেন-রকিবজান চৌধুরী, লিয়াকতজান চৌধুরী, শফিক জান চৌধুরী, রোকসানা নাসরিন চৌধুরী ও ঝুমু চৌধুরী।

আরো পড়ুন বোনকোলা গ্রাম পরিচিতি

ফসিউদ্দিন চৌধুরীর ১মপক্ষের ২ ছেলে রহিমুদ্দি চৌধুরী ও আলাউদ্দিন চৌধুরী । রহিমুদ্দি চৌধুরীর ৩ ছেলে ৩ মেয়ে। আলাউদ্দিন চৌধুরী ২ ছেলে। ফসিউদ্দিন চৌধুরীর ২য় পক্ষের ৩ ছেলে সালেহ উদ্দিন চৌধুরী, বদর উদ্দিন চৌধুরী ও কামাল পাশা চৌধুরী। সালেহ উদ্দিন চৌধুরীর ১ ছেলে ৩ মেয়ে। বদর উদ্দিন চৌধুরীর ২ ছেলে।

আব্দুল বাছেদ চৌধুরীর প্রথম পক্ষের ৪ ছেলে ও দ্বিতীয় পক্ষের ২ ছেলে এবং মেয়ে ৩ জন। ১ম পক্ষের ছেলেরা হলেন-আবু নাসের চৌধুরী, নুরুল হুদা চৌধুরী, আ. রহমান চৌধুরী ও আ. জব্বার চৌধুরী। ২য়পক্ষের ছেলে খাজা আকতারুজ্জামান চৌধুরী ও আজিম উদ্দিন চৌধুরী। মেয়েরা হলেন বাসিরুন্নেসা চৌধুরী, শরিফুন নেছা চৌধুরী (একজনের নাম পাওয়া যায় নি)। শরিফুন নেছা চৌধুরী ওরফে মুন্নি ১৯৫০ সালের দিকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সাথে লন্ডন প্রবাসী হন। তিনি একজন সুলেখিকা ছিলেন। প্রবাসে সফরে’ নামে তার একটি কবিতার বই রয়েছে। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ২৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে (১৯৭৭) একটি কবিতা লিখে রানিকে উপহার দিলে রানি তাকে পুরস্কৃত করেন।

খাজা আকতারুজ্জামান চৌধুরীর ৩ ছেলে ২ মেয়ে তারা হলেন- খাজা আমিনুজ্জামান চৌধুরী, খাজা কামরুজ্জামন চৌধুরী, খাজা নুরুজ্জামান চৌধুরী, জান্নাতুল আশরাফি (একজন মেয়ের নাম পাওয়া যায় নি)। আজিম উদ্দিন চৌধুরীর (১৯৪১-২০১৩ খ্রি.) মেয়ে আনিতা চৌধুরী, ইভানা চৌধুরী ও আজিমা চৌধুরী। 

তথ্যসূত্র:
সুজানগরের ইতিহাস ; লেখক:  ড. আশরাফ পিন্টু

পড়ুন আজিম চৌধুরীকে নিয়ে লেখা-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

জমিদার আজিম চৌধুরীর বংশ পরিচয়

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন "আমাদের সুজানগর"-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া তিনি "আমাদের সুজানগর" সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং "আমাদের সুজানগর" ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!