চাইনিজ-নট-ও-দারোয়ানের-গল্প
ইমরুল কায়েস,  ভ্রমণকাহিনি,  সাহিত্য

চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প

চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প

ইমরুল কায়েস

 

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে রাস্তায় বিদ্যুৎ খুঁটির সাথে লাগানো একটা সিম্বল চোখে পড়ে। পুরো রাস্তার সব বিদ্যুৎ খুঁটির সাথেই এই লাল রঙের সিম্বল লাগানো। পাশাপাশি দুটি সিম্বল। খাড়া দন্ডের উপর চতুর্ভুজাকৃতির উপরের দিকটা চওড়া। দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মত। রাতের বেলায় সিম্বলগুলো লাল আলোয় আলোকোজ্জ্বল হয়ে থাকে। সারি সারি এরকম আলোকিত লাল সিম্বলগুলো দেখতে অপূর্ব লাগে। মনে হয় একদল প্রজাপতি লাল পেখম মেলে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। মনে মনে প্রশ্ন জাগে নিশ্চয়ই এগুলোর কোন গুঢ়ার্থ আছে। সেটা জানতে হবে। একবার ভাবলাম চীন যেহেতু সমাজতান্ত্রিক দেশ সেহেতু একরম লাল রঙের সিম্বল থাকতেই পারে। কারণ কমিউনিস্টদের সিম্বল লাল। এ নিয়ে জানার কিছু নাই। কিন্তু একসময় ঠিকই জানতে পারলাম।

চাইনিজ-নট
চাইনিজ নট

একদিন হঠাৎকরেই এই সিম্বলগুলোর ছবি পাঠালো রুবি। জানাল এগুলোকে চাইনিজ নট বা গিঁট বলে। এর অর্থ হল ফ্যামিলি রিইউনিয়ন বা পরিবারের সবার একত্রিত হওয়া। রাস্তার নটগুলো লোহা দিয়ে তৈরি লাল রঙ দিয়ে প্রজাপতির আকার দেয়া। এটা হল এক ধরনের চাইনিজ হস্তশিল্প। চাইনিজরা লাল সুতা বা কাপড় দিয়ে এগুলো তৈরি করে ঘরে, অফিসে কিংবা অন্যান্য জায়গায় ঝুলিয়ে রাখে। পরিবারের বন্ধন, সুখ, শান্তি এবং সবার একত্রীকরণ বুঝাতেই এই নট ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে গ্রীস্মকালীন উৎসব, চাইনিজ নববর্ষ ইত্যাদি উপলক্ষে এই সিম্বল বেশি করে ঝুলানো হয়। এসব সময় সরকারি ছুটি থাকে। চাকুরী বা কর্মের জন্য বাইরে থাকা পরিবারের লোকজন ঘরে ফেরে। চীনের তাং এবং শং রাজাদের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ৯৬০ -১২৭৯) এটা চালু হয়। পরবর্তীতে মিং রাজাদের আমলে এই সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চাইনিজ নট নানান শেপের বা আকৃতির হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় আকৃতি হল প্রজাপতি, ফুল, পাখী, ড্রাগন, মাছ এবং জুতা।

আরও পড়ুন বিল গাজনার ইতিহাস

দুই বছর সাত মাস পর দেশে ফিরেছে রুবি। তাই বাড়ি ফেরার তর আর সইছে না তার। চাইনিজ নটের ছবি পাঠিয়ে সে আমাকে মেসেজ করেছে আর মাত্র কদিন, এরপর বাড়ি যাব। বাড়িতে তার ১৫ বছরের একটি মেয়ে আছে। তাকে দেখার জন্য তার সাথে একত্রিত হওয়ার তর আর সইছে না তার। আমি তো আগেই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। কোয়ারেন্টাইন হোক, কুনমিং হোক আর বেইজিং হোক আমাকে তো পাঁচ মাসের বেশি সময় থাকতে হবে। কিন্তু এই বেচারী মাত্র দুই মাসের ছুটিতে এসেছে। এরমধ্যে কুনমিংয়ে ১৪ দিন এবং ওর নিজ শহর ইউয়ানে আরও সাতদিন কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। এরপর পরিবারের সাথে একত্রিত হতে পারবে ও। দুই মাস ছুটির প্রায় এক মাস যাবে কোয়ারেন্টাইন ও আসা যাওয়ায়। বাকী একমাস কাটাতে পারবে পরিবারে সাথে। তারপরও সে খুশি। পরিবারের সাথে সহসা দেখা না হোক অন্তত দেশে তো থাকতে পারছে।

হোটেলের দুটি প্রবেশ পথ। পশ্চিম ও পূর্বদিকে। আমার স্যুটটি হোটেলের একেবারে কর্নারে। সুতরাং বেডরুম এবং ড্রয়িং রুম থেকে দুটি প্রবেশপথই দেখা যায়। দুটি প্রবেশ পথের ধারেই দারোয়ানদের অবস্থানের জন্য ঝুপড়ি ঘরের মতো ছোট্ট দুটি ঘর। দেখতে অনেকটা বক্সের মত। স্টিলের তৈরি। দুটির ঘরের ভেতর থাকেন দু’জন গার্ড বা দারোয়ান। তাদের কাজ হল প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পথ পাহারা দেয়া। তাছাড়া গাড়ি প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় রাস্তার উপরকার প্রতিবন্ধকতা উঠা-নামা করা।

মাঝেমধ্যে তাদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করি। সারাক্ষণ তাদেরকে বসা দেখি। এক নাগাড়ে বসে থাকে। বেশিরভাগ সময় মোবাইলে ডুবে থাকে দু’জনই। তবে সকালের দিকে কিছুটা ভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায় তাদেরকে। এ সময় তারা বাইরে হাঁটাহাঁটি করে। বাইরে বলতে ঝুপড়ি ঘরটার বাহিরে। অর্থাৎ হোটেল চত্বরেই হাঁটাহাঁটি করে। কালো খাকি পোশাক পরা ছিপছিপে চাইনিজ দারোয়ান। তারপরও সকালে হাঁটাহাঁটি করে, হাতের লাঠি দিয়ে শারীরিক কসরৎ করে। বোধহয় শরীরকে ফিট রাখতেই তাদের এসব কসরৎ। শুধু এই দারোয়ানরাই নয় সকালে ফুটপাথে অন্যান্য চাইনিজদেরও দেখি হাঁটাহাটি কিংবা জগিং করতে। বেশিরভাগ চাইনিজ স্থুল শরীর পছন্দ করে না। তারা শরীরকে ফিট রাখতে ভালবাসে।

আরও পড়ুন আমাদের আত্রাই নদী

যাক, দারোয়ানদের কথায় আবার ফিরে আসি। দিনের বেশিরভাগ সময় চার দেয়ালের এই ছোট্ট ঝুপড়িটায় কাটে তাদের। আপাতদৃষ্টিতে আমার সাথে তাদের এখন অনেক মিল। আমি যেমন চার দেয়ালের মাঝে সময় কাটাই তারাও বেশিরভাগ ছোট্ট ঘরটায় কাটায়। প্রথম প্রথম তাদের এই অবস্থা দেখে নিজেকে শান্তনা দিয়েছি, প্রয়োজনে মানুষকে একাকী থাকতে হয়। এসব মেনে নিতে হয়। কিন্তু দারোয়ানরাও শিফট শেষ হলে চলে যায়। তাদের জায়গায় অন্যরা আসে। তাহলে বলা যায় তাদের অবস্থা আমার চেয়ে চেয়ে ভাল। তারা মুক্ত মানুষ। দায়িত্বপালনের পর নির্দিষ্ট সময় শেষে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। কোয়ারেন্টাইন হোটেলের তথাকথিত ভিআইপিদের পাহারা শেষে তাদেরও মুক্তি মেলে। মুক্ত আকাশের নিচে উৎফুল্ল চিত্তে ঘরে ফেরে। পরিবার পরিজনদের সাথে একত্রিত হয়। চাইনিজ নটের মতোই তাদের রিইউনিয়ন হয়। স্ত্রী ছেলেমেয়ের সাথে একত্রীকরণে সংসারে নামে অপার সুখ শান্তি। কিন্তু তখনও চার দেয়ালের মাঝে কোয়ারেন্টাইনে বন্দি থাকি আমরা।

আরও পড়ুন চীনের ডায়েরি-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প

Facebook Comments Box

সাংবাদিক ও লেখক ইমরুল কায়েসের পুরো নাম আবু হেনা ইমরুল কায়েস। মিডিয়া ও লেখালেখিতে ইমরুল কায়েস নামেই পরিচিত। প্রকাশনা: আনলাকি থারটিন অত:পর প্যারিস, রোহিঙ্গা গণহত্যা: কাঠগড়ায় সুচি, চায়না দর্শন, বিখ্যাতদের অজানা কথা; অনুবাদ গ্রন্থ: দ্য রুলস অফ লাইফ, দ্য লজ অফ হিউম্যান নেচার, দ্যা আইজ অফ ডার্কনেস। তিনি ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের পারঘোড়াদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!