গোলাম রহমত আলী চিশতি
গোলাম রহমত আলী চিশতি
লোকসংগীত শিল্পী গোলাম রহমত আলী চিশতি ১৯০৫ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাশেম প্রামাণিক এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন।
বাল্যকাল থেকেই গানের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ ঝোঁক, কোনো গানের দল এলাকার আশেপাশে এলেই ছুটে চলে যেতেন, তাদের গান শুনতেন, নিজে গুনগুনিয়ে গাইতেন। তবে ১৯৩৬ সালের গানের হাতেখড়ি শুরু হয় আহম্মদ ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর গ্রামের ওস্তাদ গুপী শাহের হাত ধরে। এরপর তিনি যাত্রাপালায় গান ও হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে নিয়মিত হন। তিনি অভিনয় জগতেও নিজের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, বেহুলা-লক্ষীন্দর পালায় তিনি লক্ষীন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করতেন।
তবে তাঁর গানের মূল প্রসার শুরু হয় ১৯৬০ সালে, লক্ষীপুর শ্রীপুরের শহীদ বাউল এম এ গফুরের হাত ধরে। যিনি পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। এম এ গফুরের অনুপ্রেরণায় তিনি রাজশাহী বেতারে অডিশন দেন লোকসংগীত শাখায় এবং এরপর মারফতি, মুর্শিদী,পালা/বিচারগান, বাউল সংগীত চর্চা করেন ১৯৬২ সাল থেকে আমৃত্যু। বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন- হারমোনিয়াম, সারিন্দা, দোতারা, ডুগি তবলা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন মাওলানা রইচ উদ্দিন
সেকালে বিচারগানের আসরে গানের প্রতিযোগিতা হতো। একবার রাজবাড়ির পাংশায় তিনদিনের প্রতিযোগিতায় গুরু-শিষ্য পালায় তিনি রাজবাড়ির এক বিখ্যাত শিল্পীকে হারিয়ে দেন এবং প্রতিযোগিতার তিনদিনই মঞ্চে অবস্থান করে গান শোনান। এই প্রতিযোগিতায় নিয়ম ছিল ভক্তকূলের প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে হতো, তিনি তিনদিন প্রতিযোগিতায় মঞ্চে গান গেয়ে বিজয়ী হন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বরচিত গণসংগীত গেয়ে এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং সেইসময় এই এলাকায় ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলার আয়োজন করা হতো, তিনি লাঠি খেলা চলাকালীন সময়ে গানে গানে পাকবাহিনীর নির্যাতনের কথা তুলে ধরতেন।
এরশাদ সরকারের আমলে তিনি সুজানগর উপজেলা গণসংগীত শিল্পীদের প্রধান ছিলেন, সেইসময় স্বরচিত গান গেয়ে এই অঞ্চলের পথে প্রান্তরে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপর প্রচারণায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৪/৯৫ সালের দিকে নিজের একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন, প্রাথমিক অবস্থায় দুলাই ইউনিয়ন পরিষদের ডাকবাংলোয় স্কুল চালু করেন এবং তাঁর সেই সময়ের অনেক ছাত্রই এখনও সক্রিয়ভাবে গানের সাথে সম্পৃক্ত।
আরও পড়ুন লোকসাহিত্য বিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন
১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে বেতারে গান পরিবেশন করতেন। কালের বিবর্তনে যখন যাত্রাগান বন্ধ হয়ে যায় তখন তিনি পালাগানের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রায় তিনশ গানের রচয়িতা। তবে তিনি এই বৃহৎ কর্মময় জীবনে গানের কোনো ক্যাসেট বা অ্যালবাম প্রকাশ করেননি। তিনি তিনটি গান শুধু নিজে রেকর্ড করেছিলেন যা ছিল তাঁর হুজুরের প্রতি ভক্তি/ভজনমূলক। তাঁর হুজুর ছিলেন কুষ্টিয়ার শাহ মোহাম্মাদ মনসুর আলী চিশতি, যার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি নামের সাথে ‘চিশতি’ যোগ করেন।
সুজানগর অঞ্চলের লোকসংগীত প্রসারে তাঁর অবদান অনেক, তাঁর শতাধিক শিষ্য এখনও এই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে অবদান রাখছে। তবে এই কর্মময় জীবনে তিনি কোনো জাতীয় সম্মাননা পাননি; পাবনার দর্পণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বাংলাদেশ পুষ্টি বিভাগ এছাড়া স্থানীয়ভাবে কিছু সংগঠন তাঁকে সম্মাননা দিয়েছিল।
ব্যক্তি জীবনে তিনি অসুস্থজনিত কারণে ২০০৪ সাল থেকে আর গানে নিয়মিত হতে পারেন নি। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বার্ধ্যক্যজনিত কারণে নয় ছেলে-মেয়ে, অসংখ্য গুনগ্রাহী ও ভক্তদের কাঁদিয়ে তিনি অনন্ত অসীমের পথে পাড়ি জমান।
লেখক-
আশেক মাহমুদ সোহান
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে