গৃহবন্দি বিড়াল
গৃহবন্দি বিড়াল
মিনু কলেজ থেকে ফিরে আসার পর, তার মা তাকে জানিয়ে দিলো, তার আদরের বিড়াল বাড়িতে রাখা যাবে না। এমনিতেই দেশের অবস্থা বেশি একটা ভালো না। মানুষই খেতে পাচ্ছে না, বিড়াল পুষে কি হবে। তাছাড়া বিড়ালের শরীরে ঘা হয়েছে। পরের দিন মিনু কলেজে যাওয়ার পর, তার মা বস্তায় ভরে বিড়াল জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে।
বাড়িতে ঢুকেই মিনু কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে, ‘ডাল মে কুছ কালে হে।’
কাঁধের ব্যাগ টেবিলের উপরে রাখতেই তার মা কিছু একটা বলতে চাইল। কথা ঠোঁটের কিনারে আসতেই হাত ইশারা করে বলল, আমি সব জানি।
তোমাকে কিছুই বলতে হবে না।
মায়ের মুখের দিকে বিষ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ওয়াশরুমের দিকে রওনা হলো।
সামনের মাসে ফাইনাল পরীক্ষা মিনুর, এর ভেতর দু’জন বিয়ের ঘটক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। একজন ইতালিতে থাকে, ভালো চাকরি করে। অন্য একজন অঢেল টাকার মালিকের ছেলে। সে অবশ্য রাজনীতি করে। মিনুর কানে এখনো পৌঁছায়নি, তার বিয়ের জন্য বাবা মা দু’জন ভেতরে ভেতরে ছেলে দেখছে।
আরও পড়ুন ঐতিহাসিক গল্প সুরেন বাবু
মিনুর মায়ের কথা হলো, মেয়ে মানুষ যতই শিক্ষিত হোক স্বামীর ভাত রান্না করতেই হবে। বাচ্চা-কাচ্চা, নাতিপুতি মানুষ করতে হবে। জীবন অনেক সুন্দর। অল্প বয়সে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে রোমান্টিক সময় পার করা হলো বুদ্ধিমানের কাজ। মেয়ে মানুষের আহামরি শিক্ষিত হয়ে কি হবে? যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে তারাও একটা সময় স্বামী, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।
মিনুর মায়ের কথা হচ্ছে, মানবজীবন অতি সংক্ষিপ্ত; সেখানে নিজের জন্য সময় ব্যয় করা হলো সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান মানুষের কাজ। নারী শিক্ষার বিপক্ষে তিনি নন। তিনি জীবন, যৌনতা, বেঁচে থাকা ও পরজন্ম নিয়ে চিন্তিত। জীবনবোধের গভীরতা তাঁকে মুক্তি দেয় না। ভাবতে শিখায় নতুন ভাবে সু-মানুষ, সুনাগরিক, সুখী সাংসারিক দাম্পত্যজীবন তার কাছে সবচেয়ে দামি ও মূল্যবান। মূল্যবোধের-চর্চা মানুষের ভেতরে না থাকলেও এলিটদের সমিতিতে দৃশ্যমান। সেখানে নিজেকে জাহির করার নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
মেয়েকে বলতে চেয়ে ঠোঁটের কার্নিশে ঝুলে থাকলো প্রেমময় টকসিন সে কথা। কথার ভেতর কথা চালু হয়ে গেলে ওঝা যেমন করে সাপের বিষ নামায়, তখন শুধু কথাই বলতে হয়। সত্য না কি মিথ্যা, তখন নজর দেয় না কেউ। সবার একটাই লক্ষ্য জয়ী হতে হবে, তাতে মানুষের ক্ষতি হোক না হোক সেদিকে নজর থাকে না।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
কেউ কাউকে ক্ষতি না করলে, না ঠকালে ভেবে নেয় তার জয় হবে না। আসলে মানুষ তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন করতে পারে না, কঠোর পরিশ্রম করেও। তার তকদির থাকতে হবে। না হলে আফগান পাথর ভাঙা সেই বৃদ্ধা আজ পরিশ্রম করে ধনী হয়ে যেত।
মেয়ের ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিতে পারলেই মিনুর মায়ের শান্তি। এদিকে সে মেয়েকে মনে মনে ভয় পায়। মেয়ের স্বভাব হলো ঠোঁট কাটা। যে কোনো কঠিন কথা মানুষের ভেতর বলে দেয়, চক্ষুলজ্জা নাই। নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো নারী, নারীর অমঙ্গল নারীই কামনা করে। অথচ এই নারী যখন মা হয়ে যায় তখন সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। মেয়ের কাছে অথবা মায়ের কাছে।
যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হলেও মনের ভেতর মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক থাকে, সেটা হলো আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কের নিবিড় এক অদৃশ্য সম্পর্ক। মানুষকে সাহসী করে তোলে, সে পুরুষও হতে পারে নারীও হতে পারে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখা হলো মানুষের কাজ। অথচ লোভ ও হিংসাত্মক তৎপরতা আমাদের ঘর থেকে সংসার অথবা সমাজ নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের এখন অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে না।
কথার যাদু বানে মিনু ডুবে যাবে না, এ বিশ্বাস তার মায়ের ছিলো। অথচ শফিক একজন দরিদ্র কৃষকের সন্তান। তার প্রেমে পরার কি এমন আছে? তার মা নয় ছয় হিসেব কষতে থাকে কিন্তু মিলাতে পারে না।
ফাইনাল পরীক্ষার শেষের দিন মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পুঙ্গত্ব বরণ করতে হয়েছে মিনুর। এখন বেঁচে থাকা কঠিন। বেঁচে থাকার মত বেচেঁ থাকা সবাই থাকতে পারে না। ডাক্তার একবার আশার বাণী শোনালেও, মনের জোরে কিছুই বলতে পারছে না মিনুর মাকে।
আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা
অসীম অভাব মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাবোধ ভেদ করে লোভের ফাঁদে নিজেকে মিলিয়ে ধরলেই, গৃহবন্দী বিড়াল জীবন মানুষ ইচ্ছে করেই বরণ করছে। অথচ আমরা জীবনকে কঠিন থেকে কঠিন করছি।
মিনু বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, তার সুন্দর জীবনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল। আয়নার সামনে হুইল চেয়ার নিয়ে নিজের চেহারা দেখে আর বিভিন্ন ভাবনা তার মাথায় ভর করে। তার ভাবনাগুলো সে নিজের ডাইরিতে লিখে রাখে। যদিও ডাক্তার তাকে কোমায় রেখেছিল ন’মাস। সেখান থেকে ফিরে আসতে পারবে পরিবার তা আশা করেনি।
‘দোয়ায় দরিয়া পার’ এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। কোমা স্টিমুলেশন থেরাপি দেওয়ার পর সে স্বাভাবিক হতে থাকে ধীরে-ধীরে।
আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
অতিথি আসন
অচেনা
তৃতীয় স্বাক্ষী
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
গৃহবন্দি বিড়াল