গল্প-হলেও-সত্য
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

গল্প হলেও সত্য

গল্প হলেও সত্য

এ কে আজাদ দুলাল

 

সেই কুমার নদী আর নদী নেই এখন। জীর্ণ পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত এক কুমার। নেই তার দু’পাশে ঘন সবুজের বৃক্ষ ও তৃণ লতাপাতায় ঘেরা ছোট গ্রামটি। এই গ্রামে ধ্বংসাবশেষ জমিদার বাড়ি আজ শুধুই ইতিহাস। তবু স্মৃতিচিহ্ন তো আর মুছে ফেলা যায় না।

প্রায় চার যুগ আগে ঘটে যাওয়া এক জীবন্ত কাহিনী। গ্রামটি সবুজে ঘেরা। সবুজের মত মানুষের সরল মন। সব শ্রেণির মানুষের বসবাস। রোজকার মত হাট সেরে সন্ধ্যা নামতেই সবাই গৃহে প্রবেশ করে এবং রাতের ভোজনের পর ঘুমাতে যায়। হয়ত কারো কারো বাড়িতে বসে ভক্তিমূলক গানের আসর। তাও সেটা কদাচিৎ।

এই গ্রামের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার, তাদের আবার একটু রাত হয়। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা তাদের পাঠে মনোনিবেশে থাকে। শীতের রাত। তাই বেশি রাত অব্দি জেগে থাকা চলে না। হারিকেনের আলোতেই রাতের কার্যক্রম শেষ করে থাকে।

খাওয়া-দাওয়ার পর শোয়ার প্রস্তুতি। আজকে তার ব্যতিক্রম হলো না। শীতের রাত। লেপের গরম আবেশে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চারিদিকে নিস্তব্ধ নিশীথ রাত। জোনাকি আলোর সাড়া নেই। টিনের চালে কুয়াশার বিন্দু বিন্দু পতনের শব্দ। হঠাৎ বিরাট এক কান ফাঁটা শব্দে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাড়ির সকল ঘরগুলো কেঁপে উঠলো। মনে হলো ভূমিকম্পন। জেগে উঠলেন বাড়ির বয়স্ক পুরুষ-মহিলা আর প্রাপ্ত বয়সের ছেলে-মেয়েরা।। সবাই সজাগ। এখন কর্কশ কণ্ঠের শব্দ। এবার তাদের কাছে মনে হলো দূর্ধর্ষ কোন ডাকাত দল।

কারণ বহু বছর গত হলো পাশের জমিদার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। এরপর হতে চারিদিকে ইটের প্রাচীর আর কাঠের তেরি মজবুত দরজার বন্দোবস্ত করেছিলেন বাড়ির কর্তা। সেই জমিদারী নেই, নেই জমিদারী বাড়ির হালচাল। চিন্তার আবার বাধা পেল। কেউ যেন খোলটে দাঁড়ানো আম গাছ ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। তাহলে কি বুনো পাগলা ক্ষুর্ধাত মহিষের দল। এবার সবাই ভয় পেয়ে গেল। যুবকগন লাঠি হাতে নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। মহিলাগণ দোয়া-দরুদ পাঠ করতে শুরু করে দিয়েছে। আর কোন সাড়া শব্দ নেই। হয়ত আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু না। এবার মনুষ্যের আর্তনাদ কণ্ঠ। কণ্ঠে ভেসে আসছে করুণ মিনতি। কিন্তু কণ্ঠস্বর বড় ক্ষীণ

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক লোক সাহস করে এগিয়ে বললেন,

__আপনারা কারা? এত রাতে কি চান?

এবার মনে হলো কথা কাজে লেগেছে। আগন্তুকদের দলনেতা করুণ সুরে বললো,

__মেহেবানী করে আমাদের দয়া করুন। আমরা ক্ষুধার্ত এবং বিপদগ্রস্ত।

তখন বাড়ির পুরুষ লোকজন বাড়ির বাইরে এসে দেখে, ছোট বড় মাঝারি দশ বার জন মানুষ সন্তান। অন্ধকারে কারো চেহারা ঠাওর করা কঠিন।

__দেখুন। গভীর রাত। রান্না-বান্নার একটা ব্যাপার স্যাপার। সামনে বেড়াবিহীন কাচারী ঘর দেখতে পাচ্ছেন। আপনাদের জন্য কিছু শীতের গরম বস্ত্র ব্যবস্থা করা যাবে।

তাতেই রাজি হলো। সকল মানুষের মন তো আর এক নয়। সংসারের দয়া-মায়া-মমতা ভরা মানুষ তো আছেন। এ বাড়ির বড় বৌ বললেন,

__তাদের শীতের বস্ত্র এবং খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।

তার কাছে অতিথী পরায়ণ  ধর্ম। বিপদের দিনেই তো মানুষ মানুষের জন্য। শীতের গরম বস্ত্র হরণ করা হলো ঘুমন্ত ছেলে-মেয়েদের শরীর ওপর হতে। এ যেন এক বালতি নদীর ঠান্ডা পানি গায়ে

নিক্ষেপ করা। শুধু একজন জেদী মেয়ের গায়ের লেপ হরণ করা সম্ভবপর হলো না। শীত নিবারণের জন্য শীতবস্ত্রগুলো শীতার্ত বিপদগ্রস্ত নিশীথ রাতের অতিথীকে দেয়া হলো।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

ডাল ভর্তা গরম ভাত আপ্যায়ন করা হলো। খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করলো। রাত প্রায় শেষের দিকে। বাড়ির সামনে ঘন গাছগুলো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। গ্রামটি যেন জীবজন্তু বিহীন কোন এক বরফ অঞ্চল।

বাড়ির মুরুব্বী তাদের বাকী রাতটুকু বিশ্রাম নেয়ার অনুরোধ করলে আগন্তুকদের মধ্যে বয়স্ক একজন মুরুব্বী এবার কিছু বলার অনুমতি চাইল। বিষয়টি কেমন যেন মনে হলো।

__বেশ বলুন। কি বলতে চান?

অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন,

__আপনাদের ঘরে একটা বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। যদি অনুমতি দেন কথাবার্তা হতে পারে এবং আজই বিবাহ কার্য সম্পন্ন করতে চাই।

আগন্তুক মুরুব্বীর কথা শুনে বাড়ির মুরুব্বী আকাশ হতে পড়লেন। কেমন করে জানলো এ বাড়িতে বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। কিন্তু মেয়ের বাবা তো এখন বাড়িতে নেই। আছেন কর্মস্থলে। তাকে এত তাড়াতাড়ি সংবাদ দেয়া সম্ভবপর নয়।

বাড়ির ভেতর হতে মেয়ের মা সব কিছু শুনছিলেন। মেয়ে তো তার। বিয়ে তো দিতে হবে। কিন্তু অজানা একটা ছেলের সাথে বিয়ে। ভাবিয়ে তুললো। সকালে কথা হবে জানিয়ে দেয়া হলো।

শীতের সকাল, সবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের নরম রোদের আলো এসে গায়ে পড়ছে খোলা কাচারী ঘরের আগন্তুকদের গায়ে। বাড়ির ভেতরে কানাঘুষা হচ্ছে। ছেলেকে দেখতে হবে। শুধু তাই নয়। কোন পরিবারের সন্তান। বংশ পরিচয় শিক্ষা-দীক্ষা। সকালে আগন্তুকগণের চা-নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো।

দু’ পক্ষের মুরুব্বীগন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরিচিত হলো। ছেলেকে দেখে এবং তার পরিবারের কথা জেনে খুশি হলো সবাই। কিন্তু মেয়ের মার একটু আপত্তি। প্রথম মেয়ের বিয়ে হবে অথচ মেয়ের বাবা উপস্থিত থাকবেন না। এটা কেমন করে হয়। কিন্তু ছেলের পক্ষের লোকদের বড়ই আকুতি- মিনতি।

আরও পড়ুন গল্প কবর

সত্য কথা তো বেশি সময় গোপনে রাখা যায় না। আর সত্য না বললে কারো সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ভীরু মনের লোকেরা সত্য গোপন করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটলো। আগন্তুকগন মনে করলো সত্য ঘটনাটা আগে বলা দরকার। তাই সত্য কথা বের হয়ে এলো।

দেখুন কোন কিছু গোপন করা ঠিক হবে না। এলাকায় আপনারা সম্মানিত। সত্য কথাটা বলা উচিৎ। গত রাতে আমার ভাগনেকে বিয়ে দেয়ার জন্য আপনাদের পাশের গ্রামে মোহর খানের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিয়ের আগে যে সকল বিষয় আলোচনা হয়েছিল তা থেকে তারা সরে যায়। মেয়ের বাড়ির লোকজনের সাথে বনিবনা না হওয়াতে, বিয়ে না দিয়ে ছেলেকে নিয়ে, এই শীতের রাতে আপনার বাড়িতে আগমন। এ জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। এত রাতে আপনাদের অযথা কষ্ট দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। ঘোটক বেটা আমাদের সাথে আছে। তারই পরামর্শে অসময়ে আপনাদের মেহমান। আমাদের মান-সম্মানের প্রশ্ন। এলাকায় আমাদের নাম-ডাক আছে। আমাদের কোন দাবী নেই। আমাদের মান-সম্মান এখন আপনাদের হাতে। মেয়ে আপনাদের সুখে থাকবে। বাড়ির বড় ছেলে।

বাড়ির বড় ছেলের কথা শুনে মেয়ের মা চিন্তায় পড়লেন। তার ধারণা বাড়ির বড় ছেলেরা সংসারের প্রতি অমনোযোগী হয়। ভয় এখানেই। তিনি নিজে তা বুঝেছেন। কিন্তু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সব কিছু তো ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। আল্লাহ ভরসা। কাজী ডাকতে বলা হলো।

অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। বিবাহযোগ্য মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের মা স্বস্তি পেলেন।

এবার আগন্তুক হয়ে গেল আত্মীয়। এভাবেই মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। ভোজের আয়োজন করা হলো। ভোজেরপর কন্যা বিদায়।

চার বিহারী বাহন পালকিতে চড়ে লাল টক টকে শাড়ী পরিধান করে অজানা একটা সংসার পথে রওনা হলো এ বাড়ির বড় মেয়ে।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

গল্প হলেও সত্য

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!