কোরাস: বিভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান
কোরাস: বিভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান
আলতাব হোসেন
কবি মজিদ মাহমুদের কবিতা ‘কোরাস’ এক অনন্য মানবিক আবেদনপূর্ণ রচনা, যা সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষের সম্প্রীতি ও একাত্মতার প্রতি আহ্বান জানায়। কবিতাটির প্রতিটি স্তবকে কবি দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। এই কবিতা মূলত মানবিক ঐক্যের জয়গান, যা একাধারে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির মেলবন্ধনে রচিত।
কবিতার শুরুতেই কবি গভীর এক শোকের সুরে লেখেন, “তুমি পদতলে পিষলে- আমি পোড়ালাম আগুনে / খুব কাঁদলেন আমাদের এই অধপতন মা শুনে।” এখানে কবি সমাজে সংঘর্ষ এবং বিভাজনের যন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন। দুই ভিন্ন সম্প্রদায় নিজেদের অহংকারে বিভক্ত, অথচ এই বিভেদ একজন মায়ের মতো চরিত্রকে কষ্ট দেয়। এই মা আমাদের মাটির প্রতীক, যে তার সন্তানদের মধ্যে শান্তি এবং মমত্বের প্রত্যাশা করে। কিন্তু সন্তানদের এই সংঘর্ষ তার বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
পরবর্তী স্তবকে কবি পানির প্রসঙ্গ এনেছেন, যা জীবন ও সম্পর্কের ধারাবাহিকতার প্রতীক। কবি লিখেছেন, “যদিও আমাদের বাড়িতে ছিল একটি পানির কল / তোমার জন্য এখনো সেখানে আছে তৃষ্ণার জল।” এখানে কবি দেখিয়েছেন, ঐক্যের সূত্র হিসেবে মানবিকতা কিভাবে বিদ্যমান থাকে, যদিও আমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করি। তৃষ্ণার জল যেমন কারো একার নয়, তেমনি মানবিকতা সবার জন্য। পানি এখানে কেবল একটি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা নয়, বরং এটি মানুষের সহাবস্থানের একটি রূপক।
কবিতায় পারিবারিক সম্প্রীতির স্মৃতিও অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। “ভাব জমেছিল আমার বোনে তোমার বড় দিদায় / খালা মাসিমা ডাকত মাকে ভূগত যখন খিদায়।” এখানে কবি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন অতীতের সেই দিনগুলোর কথা, যখন পারিবারিক সম্পর্ক ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেও মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলত। একে অপরের পরিবারের প্রতি সেই আন্তরিকতা বর্তমান সমাজে অনেকাংশে বিলীন হয়ে গেছে। এটি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক নয়, বরং বর্তমান সমাজের জন্য একটি শিক্ষাও বটে।
কবিতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো নদী প্রসঙ্গ। “একটা নদী প্রবহমান ছিল একই ছিল তার সাধ / আমরা আছি পদ্মার তীরে তুমি গঙ্গায় নিয়ে বাঁধ।” নদী এখানে একটি শক্তিশালী প্রতীক, যা দুই সম্প্রদায়ের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সংস্কৃতির ভিন্নতাকে তুলে ধরে। পদ্মা এবং গঙ্গা দুটি পৃথক নদী হলেও তাদের স্রোত একই রকম। এভাবেই মানুষের ভিন্ন ধর্ম বা সংস্কৃতি সত্ত্বেও তাদের মৌলিক চাহিদা এবং অনুভূতি এক। নদীর এই ধারাবাহিক প্রবাহ মানবজাতির অটুট ঐক্যের একটি প্রতীক।
কবি মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে ধরে জীবনের শেষ চূড়ান্ত সমীকরণও বোঝাতে চেয়েছেন। “আমার পিতার মৃত্যুর পরে যত্নে দিলাম কবরে / তোমার বাবার মরদেহ ঠিক রাখলে চিতার পরে।” মৃত্যুর মাধ্যমে কবি দেখিয়েছেন যে, সব মানুষ সমান এবং তাদের শেষ গন্তব্যও এক। যদিও ধর্মীয় আচার এবং রীতিনীতি ভিন্ন হতে পারে, তবু শেষমেশ সকলেই একটি সার্বজনীন সত্যের কাছে সমর্পিত হয়। কবি এখানে জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং ধর্মীয় পার্থক্যের ঊর্ধ্বে মানুষের একাত্মতার কথা বলেছেন।
কবিতার একটি গভীর দার্শনিক দিক হলো আধ্যাত্মিকতা এবং পুরস্কারের বিষয়টি। “তারা দুজনে ভালো মানুষ ছিলেন পাবেন পুরস্কার / আমার পিতার বেহস্ত নসিব তোমার স্বর্গ সমাচার।” এখানে কবি দেখিয়েছেন, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও ভালো মানুষের পুরস্কার নির্ধারিত। কবি এ কথা বলতে চেয়েছেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা হতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের মানবিক গুণাবলি সব ধর্মেই সমানভাবে স্বীকৃত।
কবিতার সবচেয়ে গভীর এবং মানবিক অংশ হলো গান এবং ভাষা নিয়ে লেখা স্তবক। “বহু বিচিত্র বহু মানুষের হরেক ভাষা ও সংস্কৃতি / তোমার গান মায়ের ভাষায়- আমি গাই সম্প্রীতি।” এখানে কবি ভাষা এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যেও একতা এবং সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়েছেন। গান এখানে মানুষের অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ, যা জাতি এবং ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। কবি দেখিয়েছেন, মানুষের সংস্কৃতি যত ভিন্নই হোক, তাদের আবেগ এবং অনুভূতির সুর এক।
কবিতার প্রতিটি স্তবকেই রয়েছে গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা। পানি, নদী, মৃত্যু, গান—এই সব প্রতীক মানুষের জীবনের মৌলিক সত্য এবং ঐক্যের ধারণাকে প্রকাশ করে। কবিতার প্রতিটি শব্দ আমাদের বর্তমান সমাজের বাস্তবতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
মজিদ মাহমুদের ‘কোরাস’ কেবল একটি কবিতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দলিল। এটি আমাদের দেখায়, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানুষ কিভাবে একে অপরের প্রতি সহমর্মী হতে পারে। কবি এই কবিতায় দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনের সাধারণ দিকগুলোকে তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে, তাদের মধ্যে ভিন্নতার চেয়ে মিলই বেশি। এই কবিতা একটি বার্তা দেয়—ভিন্নতা নয়, বরং ঐক্যের গান গাইতে হবে।
‘কোরাস’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই একই মানবজাতির অংশ। পার্থক্যের মাঝেও সম্প্রীতির সুর তোলা সম্ভব। এটি কেবল একজন কবির কণ্ঠস্বর নয়, বরং একটি সার্বজনীন আহ্বান। কবিতাটি আমাদের কাছে সেই গান হয়ে ধ্বনিত হয়, যা সব বিভেদ ভুলে সম্প্রীতির জয়গান গায়।
কবিতা: কোরাস
কবি: মজিদ মাহমুদ
তুমি পদতলে পিষলে- আমি পোড়ালাম আগুনে
খুব কাঁদলেন আমাদের এই অধপতন মা শুনে॥
যদিও আমাদের বাড়িতে ছিল একটি পানির কল
তোমার জন্য এখনো সেখানে আছে তৃষ্ণার জল॥
ভাব জমেছিল আমার বোনে তোমার বড় দিদায়
খালা মাসিমা ডাকত মাকে ভূগত যখন খিদায়॥
একটা নদী প্রবহমান ছিল একই ছিল তার সাধ
আমরা আছি পদ্মার তীরে তুমি গঙ্গায় নিয়ে বাঁধ॥
আমার পিতার মৃত্যুর পরে যত্নে দিলাম কবরে
তোমার বাবার মরদেহ ঠিক রাখলে চিতার পরে॥
তারা দুজনে ভালো মানুষ ছিলেন পাবেন পুরস্কার
আমার পিতার বেহস্ত নসিব তোমার স্বর্গ সমাচার॥
বহু বিচিত্র বহু মানুষের হরেক ভাষা ও সংস্কৃতি
তোমার গান মায়ের ভাষায়- আমি গাই সম্প্রীতি॥
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
কোরাস: বিভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান