কে এম আশরাফুল ইসলাম
ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী কে এম আশরাফুল ইসলাম একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও গীতিকার। কে এম আশরাফুল ইসলাম পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দি ইউনিয়নের তালিমনগর গ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দেড় বছর পূর্বে দেওয়ান বংশে মঙ্গলবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মাতার ভাষ্যমতে, ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর/অক্টোবরে তাঁর জন্ম। শিক্ষা সনদ অনুযায়ী ১ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
পারিবারিক জীবন: পিতা মরহুম আনোয়ার হোসেন, মাতা মরহুমা জরিনা বেগম। পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ এবং সর্বকনিষ্ঠ আদরের ছোট ছেলে। অন্য ভাই বোনেরা পারিবারিক টানাপড়েনের কারণে পড়া-লেখা শিখতে পারেনি। পিতার কোনো আবাদযোগ্য ছিল না। সামান্য বসতভিটায় ছোট্ট ছনের ঘরে তাদের জন্ম এবং সে ঘরেই তাদের বসবাস ছিল। তাও কোনো কোনো বছর কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে ঘরের চালা উড়ে যেতো।
জীবনের বাস্তব সঙ্কট বিনিময় করে সুখি হওয়ার জন্য অতীতের বেদনা ভুলে যেতে ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর নিজ গ্রামের প্রয়াত ডাক্তার জনাব হায়দার আলী খানের জ্যেষ্ঠ ছেলে মো. হেদায়েত হোসেন টিপু খানের অষ্টাদশী কন্যা তাসনিম ডালিয়া’র সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে এ ডি এম হেজাজ বুলবুল রাফী এবং ছোট ছেলে এ ডি এম আল্লামা বিল কালাম মাহী।
কবিতার ছন্দে কবির পরিচয়-
আব্দুল আজিজ মম পিতামহ
মোকাররম প্রপিতামহ মোর
আনোয়ার হোসেন জনক যেথা
জরিনা বেগম মাতৃ অন্তর।
দেওয়ান বংশে জন্ম আমার
ওরফে ফকির বলে।
গ্রামখানি তালিমনগর
বাদাই নদীর কূলে।
সাগরকান্দি ডাকঘর মোর
উপজেলা সুজানগর।
আমিনপুর থানায় নিবাস
জেলা পাবনা শহর।
উত্তরবঙ্গ নামে খ্যাত
রাজশাহী বিভাগে বাস।
‘আকাশবীণা’ ছদ্মনামে
বাংলাদেশ আবাস।
আরও পড়ুন মো. নুরুজ্জামান
শিক্ষা জীবন: প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম তালিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপ্ত করেন। উল্লেখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখকের নিচে কারো রোল নম্বর ছিল না! ১৯৮৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে তালিমনগর শাহ মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বিকশিত জীবনে পদার্পণ করেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক (প্রয়াত) জনাব মোঃ আব্দুল কুদ্দুস স্যারের হাতে (পড়া না পারায়) বেতের আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বিকাশমান জীবনের সূচনা হয়! তখন থেকেই একমাত্র পড়া-লেখায় নিজকে সমর্পণ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় পাঁচ বছরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেরা সতীর্থ মো. নজরুল ইসলামকে টপকিয়ে সর্বশেষ সিরিয়ালের ছাত্র ক্লাসের প্রথম স্থান অধিকার করে! এ ছিল যেন জীবনে জ্যোতিষ্ক শোভিত মহাকাশ বা দুর্গম গিরি হিমালয় বা এভারেস্ট বা অতলান্তিক মহাসিন্ধু বিজয়ের মত অসামান্য বিজয়! সেই থেকে কেউ আ পিছু ফেলতে পারেনি! তবে হেরে গেছেন দারিদ্র্যের কাছে! হোঁচট খেয়েছেন বারংবার। উঠে দাঁড়িয়েছেন বুক ভরা আশা নিয়ে।
১৯৯০ সালে তালিমনগর শাহ মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অধীনে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, ইসলাম ধর্ম ও ইংরেজিতে লেটার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ঐ বছর ১৮ জন শিক্ষার্থী তালিমনগর শাহ মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৬ জন উত্তীর্ণ হয়। সেক্ষেত্রে সাগরকান্দি রিয়াজ উদ্দিন হাই স্কুল, খলিলপুর হাই স্কুল, রতনগঞ্জ হাই স্কুল এবং কাজিরহাট হাই স্কুল থেকে কেউ পাস করেনি এবং একমাত্র তিনিই ছিলেন প্রথম বিভাগে পাস করা ছাত্র। তখন এই ফলাফলের কারণে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব খ ম আব্দুল আউয়াল মন্টু সাহেব (তালিমনগর গ্রামের কৃতি সন্তান ) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক লিখিত তিনটি বই উপহার দেন; যে বইগুলোতে কবির স্বহস্ত লিখিত ফটোকপি বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বিদ্যমান ছিল। প্রাপ্ত বইগুলো পড়ে অনুপ্রাণিত এবং আপ্লুত হন।
আরও পড়ুন খলিফা আশরাফ
এইচএসসি (বিজ্ঞনা বিভাগে) ভর্তি হন সরকারি এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। পিতা অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় ঝরে পড়েন শিক্ষা জীবন থেকে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম শিক্ষা জীবন। ১৯৯১ সালে ফের ভর্তি হন সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি কলেজ, সুজানগর এনএ কলেজে। সুজানগর শহরের কোনো এক নেতার বাড়িতে লজিং হিসেবে আশ্রয় নেন। তিনি বললেন, “কেরোসিন তেল কিনে পড়তে হবে।” তাদের নেতিবাচক আচরণ জীবনটাকে আরও হতাশার কাফনে জড়িয়ে ফেলে। সপ্তাহ খানেক থাকার পর চরম ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে অর্থ সঙ্কটে ঔষধ পর্যন্ত কিনতে পারেন নি। অনেক কষ্টে সুজানগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার সাহেব একটি খাবার স্যালাইন আর দুটি মেট্রোনিডাজল দিলেন। রাগে ক্ষোভে তাও খান নি। বিষয়টা মেনে নিতে পারেন নি।
মনে অপ্রকাশিত বেদনা নিয়ে বিমর্ষ বদনে বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়ির সবার নিকট ঘটনা গোপন রাখেন। বলেই বা কি। কিন্তু তিনি পড়তে চান। উচ্চ শিক্ষিত হতে চান। আকাশ স্পর্শী স্বপ্ন আছে; শুধু মাত্র সাধ্য না।
বুকের ভিতরে থাকা অব্যাক্ত উচ্চ আশা নিয়ে ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে কাউকে কিছু না বলেই সবার অজান্তে হঠাৎ বাড়ি থেকে পলায়ন করে কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে বেলতলী হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পুনরায় শিক্ষা জীবন শুরু করে উক্ত স্কুল থেকেই ১৯৯৪ সালে পূর্বোক্ত ফলাফল নিয়ে পাস করেন। দ্বিতীয় বার এসএসসি পরীক্ষার পনেরো দিন পূর্বে তার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা ইন্তেকাল করেন। আঘাতের পর করাঘাত আসতে থাকে। বাড়িতে এসে ধর্মীয় কাজ সেরে বিষাদসিন্ধু বুকে নিয়ে জীবন যুদ্ধে রত হন। এই স্কুলের সতীর্থ শাওড়াতলী গ্রামের জলিল মজুমদারের তনয়া মিস হনুফা আক্তারের সাথে প্রেমের জালে আটকা পড়েন।
ভর্তি হন কুমিল্লার গৌরব বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাঙ্গন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে! ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বুয়েটে ভর্তির জন্য নিজকে প্রস্তুত করতে থাকেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। আকস্মিকভাবে কাজিপাড়ায় হনুফা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেলে উচ্চাভিলাষী শিক্ষা জীবনের সব প্রস্তুতি বিনা মেঘে বজ্রপাতে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন বিমল কুন্ডু
আবার জীবনে নেমে আসে অভিশপ্ত ব্রেক অব স্টাডি। হতাশার মহাসাগরে যাযাবরের মত সারা দেশে ঘুরতে থাকেন। যেন জীবনে শনির দশা বারংবার কষাঘাত করতে থাকে। একাকী জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত মনে মনে স্থির করলেন। ভাঙ্গা বুক নিয়ে পরের বছর ফের জেগে উঠেন। কলেজের সেরা ছাত্র হিসেবে ১৯৯৯ সালে রাজবাড়ি সরকারি কলেজ থেকে বিএসএস (পাস) পরীক্ষায় কলেজ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ২০০০ সালে পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ (ইংরেজি) ভর্তি হন।
কর্ম জীবন: ২০০৩ সালে তালিমনগর শাহ মাহতাব উদ্দিন হাই স্কুল এন্ড কলেজের কলেজ শাখা উদ্বোধন হলে সেখানে তিন বছর ইংরেজিতে অবৈতনিক প্রভাষক হিসেব কর্তব্য পালন করেন।
২০০৫ সালে প্রয়াত বন্ধু বিপ্লবের অনুরোধে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পরপর দুইবার মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেও ভাগ্য তাকে করুণা দেখায় নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে বন্ধুদের সহযোগিতা করতে গিয়ে নিজেই টিকে যান। ফলে ২০০৬ সালে ২ জুলাই থেকে সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দি ইউনিয়নে অবস্থিত হোগলাডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে শিক্ষকতা করে আসছেন।
লেখালেখি: কে এম আশরাফুল ইসলাম লেখালেখির অনুপ্রেরণা পান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর বিদ্রোহী কবিতাগুলো থেকে। বিদ্রোহী কবিতা তাকে কবিতার জগতে আকর্ষণ করে। কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তাঁর অধিকাংশ স্মৃতিবিজড়িত স্থানে গিয়েছেন। ভিক্টোরিয়া কলেজের পুকুর পাড়ে যেখানে বসে কবি তাঁর প্রিয়তমা প্রমিলাকে পত্র লিখতেন, সেখানে প্রায় প্রতিদিনই কিছু সময় কাটাতেন।
আরও পড়ুন ইমরুল কায়েস
১৯৮৬ সালে সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন লেখার প্রতি ঝোঁক আসে। তার প্রথম লেখা ‘আমার গ্রাম’।
এই যে গ্রাম তালিমনগর
এইখানে মোর বাস,
এই খানেতে মিলেমিশে
থাকি বারোমাস।
এই গ্রামের মাঠে মাঠে
সোনার ফসল ফলে,
এই গ্রামের গাছে গাছে
পাখপাখালি বোলে!
এই গ্রামের মানুষগুলি
অতি সরলমনা,
এই গ্রামের পর্ণনীড়েই
আমার ঠিকানা!
এই গ্রামের মাটি আকাশ
ডাকে বারংবার
এই গ্রামের বাদাই নদী
অতি চমৎকার!
ডাকে আকাশ ডাকে নদী
মাটির মায়া ঘিরে,
যেথায় থাকি মনের মাঝে
রাখি যতন করে!
কুমিল্লা জীবনে অনেক লেখা লিখেছেন, যার সবই প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার জন্য শেষ হয়ে গেছে। ২০০৫ সালে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং নানামুখী সমস্যার কারণে ২০১৭ সালে পর্যন্ত লেখালেখি বন্ধ ছিল।
দাম্পত্য জীবনে একজন সুখি মানুষ হওয়া সত্বেও অতীত লেখককে স্মৃতির মিনার হয়ে অস্ফুটবাকে নিরন্তর ভাবায়, জ্বালায় এবং কাঁদায়। লেখার রসদ যোগায়।
অপ্রকাশিত সাহিত্যভাণ্ডার :
আরও পড়ুন খোন্দকার আমিনুজ্জামান
পরিকল্পিত গ্রন্থসমূহের তালিকা:
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে