কাঠগোলাপ-ও-প্রেম
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

কাঠগোলাপ ও প্রেম

কাঠগোলাপ ও প্রেম

শফিক নহোর

 

প্রতীক্ষার প্রহর যেন সতীনের যন্ত্রণার চেয়েও তীব্র কষ্টকর। দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখছি; নিজের হাতের মোবাইল ফোনের স্কিনের ঘড়িতে সময় দেখতে ভুলে গেছি। তলিয়ে যাওয়া জাহাজের নাবিকের মতো। হালকা শীত তবুও শরীর ঘেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা শত্রুপক্ষ শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। কাঙ্ক্ষিত সময়ের কাটা ঘড়ির বুক জুড়ে জেগে উঠুক; নদীতে চর পরার মতন নতুন এক আশার প্রদীপ নিয়ে।

আবারো যখন দেওয়াল ঘড়িটার দিকে নিজের অজান্তে দৃষ্টি চলে গেল, ঠিক তখন মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। বুকের ভেতর থেকে ছন্দের তালে নেচে উঠল হৃদয়। কোনো আনন্দের সংবাদ নেই, কোনো মানুষের আগমন নেই। শুধু একটি রিংটোনের শব্দে হৃদয় এমন আন্দোলিত-শিহরিত হতে পারে নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না-এমন মধুময় সময় ৷

ভেবেছিলাম রাসেলের ফোন। কণ্ঠস্বর শুনে সন্দেহ হল; এটা রাসেলের কণ্ঠস্বর না। কিন্তু রাসেল আমাকে কথা দিয়েছিল দশটায় ফোন দেবে। অনেক সময় রাসেল ভিন্ন নম্বর দিয়ে কল দিয়ে আমার সঙ্গে দুষ্টামি করত, আমি প্রথমত তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে কেমন যেন উল্টাপাল্টা মনে হতে লাগল, সবকিছু আমার কাছে। আমি মোবাইল ফোনের ডায়াল কল থেকে রাসেলকে পুনরায় ফোন দিলাম। অযাচিত একটি কণ্ঠ থেকে ভেসে আসল, আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন, এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

আমার আর করার কিছুই রইলো না তখন। ইন্টারনেটের উপর ভরসা। মোবাইল ফোনের ডাটাটা অন করে ফেসবুক থেকে একটু ঢুঁ মেরে এলাম। তেমন কোনো কিছুই চোখে পড়ল না।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

আমার পাঠানো মেসেঞ্জার ইনবক্স চেক করলাম, এখনো সিন হয়নি। এক ঘণ্টা পনের মিনিট আগে ফেসবুক থেকে লগ আউট হয়েছে; অথবা নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। রাসেল আরো দুটি সিম কার্ড ব্যবহার করে। সে দুটি মোবাইল নম্বর আমার কাছে ছিল। সেগুলোতে ট্রাই করলাম; সেই একই কথা। বিরক্ত হয়ে ফোন বিছানার উপর ছুড়ে দিলাম। করিডরের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রাতের নিয়ন আলোয় দৃশ্য দেখতে লাগলাম। ফুটপাতে কেউ-কেউ সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু দৃশ্য এমন ছিল।

মশারি নেই, বালিশ নেই, বিছানার চাদর নেই। নগ্ন আকাশের নিচে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়বে এই ছিন্নমূল মানুষগুলো। এদের জীবন দর্শন দেখলে তখন নিজেকে বলতে ইচ্ছে করে এসব কী শুধুই মিথ্যে মোহমায়া। এই অর্থে সৃষ্টিকর্তা আমাদের সম্পদ কম দেয়নি। তবুও এর পেছনে অবিরত ছুটে চলছি, অজানা এক ঠিকানায়।

করিডর থেকে রুমের ভেতরে যাব ঠিক এমন সময় হঠাৎ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ফুট-ওভার ব্রিজের দিকে। রাসেল একটা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। অল্প আলোতে রাতের বেলায় দুই-তিনশ মিটার দূরের কোনো কিছু দেখা ভুল হতেও পারে ভেবে, আমি তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে, নিজের রুমে চলে এলাম। ঐ দিন গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম আসলো না। বিছানার এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাসেলকে ফোনকল করলাম, রিং হলো, রিসিভ হলো না। আমি মনে মনে ভাবলাম রাসেল কি বিশেষ কোনো কারণে আমার উপর অভিমান করে আছে? তবে কেন সে এমন করছে? আমি কি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি? কোনোভাবেই কোনো হিসাব মিলছে না আমার নিজের কাছে। এ যেন বাইনারি হিসাব এক আর এক যোগ করলে ‘এক’ হয়।

আরও পড়ুন একজন অনন্যা

সকালের নাস্তা সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিব ঠিক তখন রিংটোন বেজে উঠল, রাসেলের ছবিসহ মোবাইল স্ক্রিনে। মোবাইল ফোনটি আলগোছে কানের কাছে ধরতেই, বড়ো আহ্লাদ করে বললো,
_দীপা, আমি তোমাকে ভালোবাসি সত্য। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি একটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। প্লিজ! আমাকে তুমি ক্ষমা কর। তুমি ক্ষমা না করলে তোমার সামনে কখনো আসব না। আমাকে কথা দিতে হবে তুমি আমাকে সত্যিই মন থেকে একেবারে ক্ষমা করে দিয়েছ।
_রাসেল, তুমি পুরুষ মানুষ, তোমার চোখে জল বেমানান! তোমার স্যাঁতসেঁতে কণ্ঠ আমাকে ভীষণভাবে আহত করছে।
রাসেলের কথাবার্তা শুনে আমার শরীরের লোম শিউরে উঠল। নিজেকে সংযত রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। আমি বলেছিলাম
_আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখব। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না রাসেল। তুমি কেনোইবা আমার সঙ্গে এমন করছো, আমি নিতে পারছি না।
_দীপা প্লিজ! তোমার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই, আজ এবং এখনই। তোমার বাসার ঠিকানাটা টেক্সট কর।

আরও পড়ুন গল্প লালু

রাসেলের কথার ভেতরে কেমন যেন একটা গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। রাসেল শামুক চরিত্রের মানুষ। আমার জীবনে প্রথম যাকে আমি কাছে টেনেছি, সে রাসেল। ও আমাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই রাসেলের প্রতি আমার দুর্বলতা কাজ করে সবচেয়ে বেশি। বাবা-মা বাসায় না থাকলে বাসায় আসতে বলেছি, অনেক সময় আসেনি। সেদিন সময় দিয়েছে কোনো পার্ক অথবা রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা হয়েছে। আমি দুষ্টামি করে আকার-ইঙ্গিত দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়েছি; খুব সহজ ও সাবলীলভাবে বলছে, তুমি তো আমার, শুধুই আমার। বিয়ের পরে এসব চ্যাপ্টার প্লিজ!
একজন পুরুষ মানুষ, এসময়ের তরুণ ছেলে রাসেল। তাকে দেখলে আমার সত্যি গর্বে বুক ভরে ওঠে। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি। যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি ।
রাসেল বাসার গেটে এসে আমাকে কল দিচ্ছে, আমি সিসি টিভিতে দেখলাম। ফোন না দিয়ে নিজেই গেট থেকে রাসেলকে রিসিভ করলাম। ড্রয়িং রুমে রাসেল খুব নার্ভাস প্যারালাইজড মানুষের মতো কণ্ঠে জড়িয়ে বলছে, আমাকে নয় লক্ষ টাকা দিতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন। আমি প্রশ্ন করলাম,
_তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে?
_কেন? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?
_ঠিক তা নয়। টাকার অংকটা বড়। আমি মনে করি এটা জানা আমার অধিকার আছে। তাই না রাসেল?

আরও পড়ুন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে

কথা শুনে রাসেলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। ব্যাংকের একটা চেক দিলাম। বাবার ব্যাংক ব্যালেন্স, তিনটা কোম্পানির দায়িত্ব আমাকে দিয়ে রেখেছেন। পছন্দের মানুষের জন্য একটু রিস্ক নিতেই হয়। রাসেলকে প্রথম থেকেই আমার পছন্দ, তার চেয়ে বড় কথা তাকে আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসি। সম্মানবোধের একটা জায়গা থেকে তাকে টাকা দিতে আমার মন সায় দিয়েছিল। চেক হাতে পাওয়ার পর রাসেল নিতে রাজি হলো না, আমি ভীষণ অবাক হলাম।
_কী ব্যাপার, তুমি টাকা চাইছো, চেক লিখে দিলাম। এখন নিতে চাইছো না কেন?
আমি তোমাকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। প্রেমিকা হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে টাকাটা নিতে পার। যখন চেয়েছো লজ্জা পেলে না। এখন নিতে লজ্জাবোধ করছো কেন? তাছাড়া আমি তো তোমার আপন মানুষ।
পুরুষ মানুষের লজ্জা আছে- এটা মেয়েরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না। রাগেল যোগাযোগ করেনি।
রাসেল টাকা নেওয়ার পর আর কখনো যোগাযোগ করেনি। বেশ কয়েক বছর অপেক্ষায় ছিলাম। আমার কোনো অভিযোগ, অভিমান বা আক্ষেপ নেই।
তবে রাসেল বড় ভাল ছেলে- এ বিশ্বাস এখনো ওর প্রতি আছে। জানি না কখনো দেখা হবে কি-না। তারপর থেকেই আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি।

আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

_রিপা ৫০৭ নম্বর রুমের রোগীর কী অবস্থা?
_দেখে তো ভাল মনে হল, স্বাভাবিক। ফাইনাল রিপোর্ট তো আপনি দেখবেন।
_স্যার তার এক প্রেম কাহিনী শুনলাম আজ।
_শুনে খুব মজা পেয়েছেন?
_ঠিক তা নয় স্যার, কাহিনী খুবই কষ্টের। সে একটা ছেলেকে ভীষণ বিশ্বাস করত, ভালোবাসতো। কিন্তু ছেলেটি একদিন হঠাৎ অনেক টাকা চেয়ে বসল। মেয়েটি বিশ্বাস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটি তার বিশ্বাস রাখতে পারেনি।
_রিপা, ছেলেদের অনেক মানুষকে খুশি রাখতে হয়। পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষকে। সেখানে একজন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করলে, এ পৃথিবীর মানুষ তাকে খুব খারাপ বলবে না হয়ত! আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন রিপা, রোগী তার স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছে। তাই আমি এখান থেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
—স্যার এটা তো আনন্দের সংবাদ। আপনি দেখা না করেই চলে যাবেন?
_পৃথিবীর সব আনন্দের মাঝেই বেদনা লুকিয়ে থাকে। পরাজয়, ঘৃণা লুকিয়ে থাকে। তা নিয়ে অন্য মানুষের সামনে যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না। তাই নিজেকে আড়াল করছি।

আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
বিষফুল
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
পুরাতন বটবৃক্ষ
আড়ালের চোখ
নীরুর মা
তিলতাল
পরাভূত

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কাঠগোলাপ ও প্রেম

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!