কমরেড-প্রসাদ-রায়
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  তাঁতিবন্দ (গ্রাম),  তাঁতিবন্ধ,  ভাষা সৈনিক,  মুক্তিযোদ্ধা

কমরেড প্রসাদ রায়

কমরেড প্রসাদ রায় (১৯২৮-১৯৯৬ খ্রি.) ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।

জন্ম: ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রসাদ রায় ১৯২৮ সালের ৫ আগস্ট, পাবনার প্রতাপ ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের তাঁতীবন্দ গ্রামে। 

পারিবারিক জীবন: বাবা প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং মা শবসনা রায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে প্রসাদ রায় ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কমরেড প্রসাদ রায়ের বড় ৪ ভাই যথাক্রমে প্রবীর রায়, প্রদীপ রায়, প্রণব রায় এবং প্রণিত রায়। 

স্ত্রী মীরা রায়। মেয়ে বৃত্বা রায় দীপা এবং ছেলে অঞ্জন রায়।

শিক্ষা জীবন: প্রসাদ রায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৪২ সালে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন ১৯৪৫ সালে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন এবং ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠেকর ভূমিকা পালন করেন। সুজানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রসাদ রায় ছোটেবলা থেকেই খেলাধূলা করেতন। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়তেন। খেলাধুলার সাথে গান পরিবেশন, কবিতা আবৃত্তি ও নাটেক অভিনয় করতেন। তাঁর এইসব বিশেষ গুণাবলীর জন্য স্কুলের শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি  প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন।

১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে আন্দালেনর সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তিনি পাবনা ও রাজশাহী জেলে প্রায় ৪ বছর আটক ছিলেন। এই সময়ে ১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলার খাপড়া ওয়ার্ডে আটক রাজবন্দীরা বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে রাজবন্দীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ৭ জন নিহত হয় এবং প্রসাদ রায়সহ ৩২ জন বন্দী মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। প্রসাদ রায়ের শরীরে ৭টি স্থানে গুলিবদ্ধ হয়। 

উল্লেখ্য ঐ একই দিন পাবনার আমিনুল ইসলাম বাদশা একইভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলন। 

আরও পড়ুন সুজানগর উপজেলার একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আজিজুর রহমান

বন্দী জীবন: প্রসাদ রায়কে রাজনৈতিক জীবেন অসংখ্যবার জেলে যেতে হয়। তিনি ১৯৪৯ সাল থেকে ৫৩ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বছর জেলে ছিলেন। ৫৩ সালে মুক্তিলাভের পর ৫৪, ৫৫ এবং ৫৮ সালে তিনবার জেলে যান। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দেআইয়ুব খানের সামিরক সরকার গ্রেপ্তার করে ৪ বছর একটানা জেলে রাখেন। ১৯৬২ সালে কারামুক্তির পর ১৯৬৫ সালে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৬৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দালেনর সময় আবার গ্রেপ্তার হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার হয়ে একটানা ৩ বছর কারাগারে ছিলেন। সামরিক সরকার জেনারেল এরশাদের সময়েও তাঁকে জেলে যেতে হয়। তাঁর ৬৮ বছরের জীবনকালে ১৯ বছর ৫ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। এছাড়া তার রাজনৈতিক জীবনে ৭ বছরের বেশি সময় পলাতক থাকতে হয়েছে। 

রাজনৈতিক জীবন: প্রসাদ রায় ছাত্রজীবনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে অংশ নেয়। স্বপ্ন দেখতেন সমাজ পরিবর্তনের। ধনী-গরীবের ব্যবধান নয়, সমাজ হবে সকলের। এই সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায়। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সমাজতন্ত্র। শত লোভ লালসা ত্যাগ করে আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন যে করেই হোক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর সময়কালে এই অঞ্চলে সমাজ পরিবর্তনে স্বপ্ন দেখার সারথী ছিলেন কমরেড অমূল্য লাহিড়ী, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল, নারীনেত্রী সেলিনা বানু, সাইফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম বাদশা, রণেশ মৈত্র প্রমুখ। প্রসাদ রায় ছাত্র ফেডারেশন, মুকুল ফৌজ, ন্যাপ প্রভৃতি সংগঠেনে কাজ করেলও তাঁর আপাদমস্তক জুড়ে ছিল কমিউনিস্ট এবং লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বৃটিশ শাসনকাল, পাকিস্তান সময়কাল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন। 

আরও পড়ুন পাবনায় প্রথম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধ শহীদ বুলবুল

এই রাজনীতিক তাঁর পরিবারের আভিজাত্য ত্যাগ করে আজীবন গরীব-দুঃখী মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। জমিদার, জোতদার আর সম্পদশালীদের কাতার থেকে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন গরীব সর্বহারাদের কাতারে। তাঁর ঠাকুরদা প্রতাপ রায় ছিলেন সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দ জমিদারের জামাতা। পাবনার মধ্য শহরে প্রতাপ রায় ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী। বর্তমানের রায়ের বাজার মার্কেট থেকে দক্ষিণের আল-আকসা মার্কেট, বর্তমান আওয়ামী লীগ অফিস (তৎকালীন কৃষি ব্যাংক ভবন), বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট (তৎকালীন বিশ্বাস কোম্পানি) থেকে দক্ষিণের মিউচুয়াল স্ট্রাট ব্যাংক পর্যন্ত ছিল প্রতাপ রায় পরিবারের সদস্যদের। বর্তমানকালে সামনের স্থাপনাগুলির পিছনেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী প্রতাপ রায় পরিবারের বাড়িগুলি। এইসব স্থাপনার উত্তর অংশে আজকের রায়ের বাজার এবং সাথেই লক্ষ্মীমিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটাই কমরেড প্রসাদ রায়ের জায়গা।

বাবা মায়ের পাঁচ সন্তান একই সময়ে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলেন জড়িত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে তাঁর দল এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের পর কমরেড প্রসাদ রায় পাবনা জেলা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অংশ নেন। পাবনায় গঠিত স্বাধীনতা সংগ্রাম পারিষদের সদস্য ছিলেন। ২৭ থেক ২৯ মার্চ তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়। ১০ এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাট হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্বিতীয় দফায় পাবনা প্রবেশ করলে কমরেড প্রসাদ রায় ভারত গমন করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি ভারেতর করিমপুরে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন এবং সেখানকার ট্রানিজিট ক্যাম্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কমরেড প্রসাদ রায় প্রত্যাবর্তন করলেন। ভগ্নদল আর ভগ্নসংসারে দৃষ্টি দেন।

মৃত্যু: আজন্ম বিপ্লবী এই নেতা ১৯৯৬ সালে ৭ ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরলোকগমন করেন। 

আমিরুল-ইসলাম-রাঙা
লেখক আমিরুল ইসলাম রাঙা, রাধানগর মজুমদার পাড়া, পাবনা।

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কমরেড প্রসাদ রায়

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!