কবর
কবর
রাতুল হাসান জয়
উদ্দেশ্যেহীন হাঁটছি। কোথাও যাবার জায়গা নেই। অপার্থিব জোছনা ঢেউ খেলছে চারপাশে। দেখতে ইচ্ছে করছে না। কিছু মানুষকে প্রকৃতি তার রূপে মুগ্ধ করতে পারে না। এই কিছু মানুষের একজন আমি। ঝুম বৃষ্টি, গাছে ঝুলছে বাদল দিনের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সব ধরনের কদম ফুল। সন্ধ্যার আকাশে পিচ ঢালা পথের ঠিক ওপরে গাছের ফাঁকে উঁকি দেওয়া অপার্থিব জোছনা; কোন কিছুই আমায় টানতে পারেনি কখনো। জন্ম থেকেই এমন নাকি ধীরে ধীরে ভালো না লাগা তৈরি হয়েছিলো আমার জানা নেই। তবে ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ালে নয়নতারার মতো ছায়া পরে। সেটা দেখতে ভালো লাগে।
যাদুর শহর ঢাকার আসল যাদু কেবল রাতেই দেখা যায়। রাজপথে শ্মশানের নীরবতা, রংবেরঙের আলো। কবি সাহিত্যিকরা শহরের এই সৌন্দর্য রাত জেগে উপভোগ করেন। লেখেন। আমার বিরক্ত লাগে। এই নীরবতা আর আলো এমন দেখার কি আছে? রাত থাকবে রাতের মতো গাঢ়ো অন্ধকার। অন্ধকারে সুন্দর বলতে আমার কাছে মনে হয় নিজের নিঃশ্বাস। নীরব অন্ধকারে নিজের কানেই নিজের নিঃশ্বাস আঘাত করে। নিজেকে জীবিত মনে হয়।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
বাড়িওয়ালা ঘর ছাড়তে বলেছেন। আফসোস হতে পারতো, কিন্তু হচ্ছে না। কারণ আমি নিশ্চিত এ সময়ে আমার মত চাকরি উপযুক্ত বহু বেকারের শহর জীবন এই বাক্যে খাবি খাচ্ছে। এই শহরে না জানি কত শিক্ষিত ও চাকরি উপযুক্ত বেকার আছেন যারা টিউশনিতে জীবনযাপন করেন। তাদের মাঝের অনেকেরই টিউশনি যায় প্রণয়জনিত কারণে। তাদের চেয়ে নিজেকে এক্সেপশনাল মানা যায়৷ কারণ আমার টিউশনির সাথে আশ্রয়টাও গেছে। মানিব্যাগে সর্বসাকুল্যে একশো বত্রিশ টাকা। পকেটে আরও দু টাকার জানান দিচ্ছে কয়েনের পরিবর্তে পাওয়া একটা লজেন্স। বেকার জীবনে সবচেয়ে আপন বলতে যাকে বুঝায়, সেই বন্ধুর অপেক্ষায় বসে আছি এই মৃত রাস্তায় সোডিয়াম আলোর নিচে সোডিয়াম লাইট বাথ করতে করতে। বুক পকেটে একটা চিঠি হৃদপিণ্ডের সাথে ওঠানামা করছে। আর্শির চিঠি। আগের চিঠিগুলোর চেয়ে এর পোড়ানোর ক্ষমতা প্রলয় সমান। যে চিঠি পড়ার পর বুকের গভীরে চাপিয়ে রাখা ভালোবাসার অনুভূতিটা আচমকা জেগে উঠেছে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে। এ ব্যথা আমি লুকাবো কোথায়!
সাদা কাগজে লাল কালিতে লেখা প্রতিটা অক্ষর। লিখতে বসে কেঁদেছে খুব। বোঝা যায়। বেশ কয়েকটি শব্দের কালি চোখের জলের ফোঁটায় লেপ্টে গেছে।
মাস্টারদা,
বহু দিবস পর মেঘের মাঝে একরাশ আদর ছোঁয়া মায়া দেখতে পেয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কারণ অভিমানের পাহাড় ক্রমশই বড় হচ্ছে। সে পাহাড় আড়াল করে দিচ্ছে মায়ার আবেদন। আপনি কতকাল আগে এক শ্রাবণের মেঘে আমায় ভিজিয়ে ছিলেন। তার আলতো অনুভূতি নিয়ে এখনো ঢের বাতাস বইছে ভেতরে। আপনি কষ্ট দিলে আমি মোটেই কষ্ট পাই না। কিন্তু আপনার ভালোলাগা অনুভূতিকে যারা মূল্য দেয় না, তাদের খুঁজে ফিরি আবডালে। পৃথিবীর সকল খারাপ পরিস্থিতিই মেনে নিতে শিখে গেছি। কিন্তু বহু দূরে থাকার চেষ্টা করেও আপনাকে ফেলতে পারছি না মন থেকে। আপনি যেন জোঁকের মত জেঁকে বসেছেন আমার ভেতর বাহিরে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে আপনার দেখা মেলে, তাতেই যেনো আমি প্রাপ্তির ঢেঁকুর গিলি। স্বপ্ন ভাঙতেই পিপাসায় গলা শুকিয়ে যায়। আমি জানি এসবই আলো ছায়ার খেলা। তবু আনন্দ খুঁজি। কারণ আপনাকে বাস্তবে পাওয়ার স্বপ্নটা কেবলই মিঁইয়ে আসছে।
আরও পড়ুন গল্প হাতের চুড়ি
জানেন সময় যতই গড়ায়, ভীতু মন আপনাকে আরও কাছে পাবার ব্যাকুলতা দেখায়। ইদানিং যেন কলিজাটা অনেক বড় হয়ে গেছে, প্রায়ই মনে হয় শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আপনাকে তুলে এনে যোগ্য আসনে ঠাঁই দেই। কিন্তু বাস্তবতা আজ যেন সব অন্ধকারে ধরা দেয়, স্বপ্নরা আজ যেন পুতুল খেলে আমার অবুঝ মনের সাথে। কাক ডাকা ভোরের কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যেন সব ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছে। আর আপনাকে না পাওয়ার ব্যথায় হৃদয়ের ক্ষতস্থান বড় হচ্ছে ক্রমশই। হৃদয় যেন ব্যথা পোষার এক চৌবাচ্চা।
মন চাইলেই তো মনের কোণ থেকে কাউকে সরানো যায় না মাস্টারদা। আজ আপনাকে না পাওয়ার বেদনায় শুষ্ক মন আর পানির তৃষ্ণায় ছটফট করে না। শূন্যতার হাহাকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার স্বপ্নেরা যেন পুরোনো জমিদার বাড়ির অভিশপ্ত কোন কুয়া। ভয়ংকর কিছুর আশংকায় ভরাট করে ফেলছে চারপাশের মানুষ। আচ্ছা আপনি কি পারেন না রুখতে এ নিয়তি? আমার বড় সাধ আপনার কোলে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাসটুকু বের করার। আপনাকে এতটাই ভালোবাসি যে আপনি ছাড়া আমার কোন গোপন নেই। আপনি আমার আবেগ ঢালার গোপন ও একমাত্র সরাই খানা। আপনি আমায় ফুল বলেন। আপনি কেন সেই মাটি হতে পারছেন না মাস্টারদা? ভীষণ রোদে নিয়তি মেনে পাপড়ি ঝরার পরে যে পেতে দেয় বুকের কবর। পারেন না মাস্টারদা?
আপনার
আর্শি
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
রাত পোহালেই আর্শির বিয়ে। ছেলে ডাক্তার। দেবদূতের মতো চেহারা। আমার চারকূলে কেউ নাই। আন্টি বড় ভালো মানুষ। দুঃসময়ে আমায় থাকতে দিয়েছেন। ঘরভাড়ার চাপ যেন কমে তাই আর্শিকে পড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সপ্তাহে তিনদিন।গৃহপালিত শিক্ষক হয়ে আর্শির সব পাগলামি বুঝলেও আমি অনুভূতিতে পাথর ছিলাম গোটা সময়। শামুকের মতো নিজেকে গুঁটিয়ে রেখেছি তার ভেজা চাহনিতেও। গত একমাস পড়াচ্ছি না। পড়াচ্ছি না কারণ আন্টি নিষেধ করেছেন। আমিও যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। যার পকেটে সর্বসাকুল্যে একশো বত্রিশ টাকা, চড়ুই পাখির জীবনযাপন করছে বাবুই, তাকে ভালোবাসা বাঁচিয়ে চলতে হয়। বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে পথে দেখা হয়েছিলো আর্শির সাথে। আহত গলায় তার শেষ প্রশ্ন ছিল ‘চিঠি পড়ার পরও কি কিছুই বলার নেই মাস্টারদা’?
একটু থেমে পা বাড়ানোর আগে বললাম, ‘সব মাটিতেই কবর হয়না আর্শি’।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
কবর