ইয়ানছি-হোটেল-ও-করোনা-সতর্কতা
ইমরুল কায়েস,  ভ্রমণকাহিনি,  সাহিত্য

ইয়ানছি হোটেল ও করোনা সতর্কতা

ইয়ানছি হোটেল ও করোনা সতর্কতা

ইমরুল কায়েস

 

চীনের কুনমিংকে বলা হয় বসন্তের নগরী। বছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে বসন্তকালের আধিপত্য। আবহাওয়া খুবই সুন্দর। খানিকটা শীতলতার পরশ বোলানো। কিন্তু একেবারে শীতার্ত নয়। এর আগেও বেইজিং যেতে কুনমিং হয়ে যাওয়া পড়েছে। কিন্তু থাকার সুযোগ হয়নি। কুনমিং হল চীনের গেটওয়ে। এই শহরকে ফুলের শহরও বলা হয়। কারণ পুরো শহর জুড়ে রয়েছে ফুলের ছড়াছড়ি। পাহাড়ের পাদদেশে মনোরম নয়নাভিরাম একটি শহর। এবার এই শহরে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে। রাতের বেলা রাস্তার আলোকবাতি, স্বল্প গাড়ি-ঘোড়া আর আশপাশের আলোকোজ্জ্বল ভবন ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না।

ইয়ানছি-হোটেল
ইয়ানছি হোটেল

বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আধা ঘণ্টার ড্রাইভ। তবুও হোটেলে পৌঁছে রুমে যেতে যেতে রাত ১২টা বেজ গেল। হোটেলের নাম ইয়ানছি। এটি একটি কোয়ারেন্টাইন হোটেল। দেশের বাইরে থেকে যারাই আসে তাদেরকে এই হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। দেশি-বিদেশি সবার জন্য ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামুলক। এরপর যার যার গন্তব্যে গিয়ে সেখানে আবার ৭দিনের কোয়ারেন্টাইন। করোনার কারণে আপাতত এটাই চায়না সরকারের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলা যায়। কারণ দুদিন আগেও এই কোয়ারেন্টাইনের সময় ছিল ২১ দিন। চীনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় তা কমিয়ে ১৪ দিন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন বিল গাজনার ইতিহাস

আমাকে আপাতত আগামী ১৪ দিন ইয়ানছি হোটেলের বড়সর এই সুটেই কাটাতে হবে। তবে এটাকে ছোটখাট একটা অ্যাপার্টমেন্ট বললেও অত্যুক্তি হবে না। একটা বেডরুম, ড্রয়িংরুম, দুইটা টয়লেট, একটা বাথরুম সাথে বাথটাব। টেবিল, চেয়ার, সোফা, আলমারি, দুইটা টিভিসহ অ্যাপার্টমেন্টটি খুব সুন্দর করে সাজানো। সব মিলে ছয় থেকে সাড়ে ছয়শ স্কয়ার ফুট হবে। ভেতরে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। অর্থাৎ একজন মানুষ যাতে টানা দুই সপ্তাহ এখানে থাকতে গিয়ে বোরিং ফিল না করে। আগামী দুই সপ্তাহ এই আবদ্ধ জায়গায় কিভাবে কাটাব সেই চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাতে খুব একটা ভাল ঘুম হল না। আগে থেকেই এ সমস্যা আমার। দেশের বাইরে গেলে রাতে ঠিকমত ঘুম হতে চায় না। সকালের দিকে কিছুটা ঘুম হল। তাতেই পুষিয়ে নেয়া যাবে মনে হয়। রুবির ফোনে ঘুম ভাঙে। জানালো দরজার সামনে রাখা চেয়ারে নাস্তা আছে। তার সাথে কথা শেষ করে নাস্তা ভেতরে নিয়ে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তায় রাইচ স্যুপ (অনেকটা লাল চালের পান্তাভাতের মত), ডিম, কলা ও সবজি স্যুপ দিয়েছে। পেটে ক্ষুধা। তাই স্বাদের কথা চিন্তা না করে গড়গড় করে খেয়ে ফেললাম। যদিও রাইচ স্যুপ সবটা শেষ করা গেল না।

আরো পড়ুন চরদুলাই গ্রাম পরিচিতি

এগারটা বাজতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখি পিপিই পরা স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন। দরজা খুলতেই ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন স্যাম্পল সংগ্রহ করবেন। কি আর করা। স্যাম্পল নিয়ে চলে গেলেন তারা। বিকেলের দিকে আরেক দফায় স্যাম্পল দিতে হল। আগেরদিন বিমানবন্দরেও একদফা স্যাম্পল দিতে হয়েছে। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম এভাবে প্রতিদিন স্যাম্পল নিলে সুস্থ নাক নিয়ে দেশে ফিরতে পারব কিনা সন্দেহ। কারণ স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য এরা যেভাবে নাকের গহীনে কাঠি প্রবেশ করাচ্ছে তাতে এমন সন্দেহের উদ্রেক অবান্তর নয়। পরে রুবি অবশ্য জানালো ১৪ দিনে পাঁচ দফা স্যাম্পল সংগ্রহ করবে। তার কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তত প্রতিদিন স্যাম্পল দিতে হবে না। তবে প্রতিদিন দুই বেলা নিয়ম করে শরীরের তাপমাত্রা মাপতে লোক আসে। তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় নাই।

আসলে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনারা খুব সতর্ক। এজন্য বেশ কিছু বিধিনিষেধ বজায় রেখেছে। বিধিনিষেধ মানার ব্যাপারে কড়াকড়ি আছে। কেউই নিয়মের উর্ধ্বে নন। কোয়ারেন্টাইন বাদেও স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে দায়িত্বরতদের জন্য পিপিই পরা, মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামুলক। তাছাড়া টার্গগেট লকডাউন, টার্গেট এলাকায় গণহারে পরীক্ষাসহ নানা ব্যবস্থা তো আছেই। কুনমিং বিমানবন্দরে দায়িত্বরতদের সবাইকে আপাদমস্তক পিপিইতে ঢাকা অবস্থায় দেখেছি। এমনকি বিমানবালাদেরও দেখেছি তাদের সৌন্দর্য আব্রু সব পিপিইতে ঢাকা। হয়তো এসব কারণেই চীনের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

আরও পড়ুন আমাদের আত্রাই নদী

করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য চীন ডায়নামিক জিরো কোভিড পলিসি গ্রহণ করেছে। এই পলিসিরি মূল লক্ষ্য হল মানুষের জীবন যেমন বাঁচাতে হবে তেমনি তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখতে হবে। যাতে দেশের সার্বিক উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ না হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ করোনা বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল করেছে। করোনার সাথে বসবাসকেই মেনে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে চীনের অবস্থান পরিস্কার। জিরো কোভিড নীতির আলোকে যতক্ষণ পর্যন্ত না করোনা একেবারে শেষ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। একইসাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক এবং সচল রাখা হবে।

চীনের জিরো কোভিড পলিসির অর্থ এ নয় যে কেউই করোনায় আক্রান্ত হবে না। বরং এর অর্থ হল করোনাকে এমন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে যাতে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় থাকে এবং জনগণের উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। এই অ্যাপ্রোচের আরেকটি মূখ্য অর্থ হল আক্রান্তকে দ্রুত চিহ্নিত করা, কমিউনিটিতে ভাইরাস যাতে আর না ছড়ায় সে ব্যবস্থা নেয়া, যাতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদ রক্ষা করা যায়।

 

(লেখক বাংলাভিশনের বার্তা বিভাগে স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত। বতর্মানে ফেলোশিপ করতে চীনে আছেন।)

আরও পড়ুন চীনের ডায়েরি-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ইয়ানছি হোটেল ও করোনা সতর্কতা

Facebook Comments Box

সাংবাদিক ও লেখক ইমরুল কায়েসের পুরো নাম আবু হেনা ইমরুল কায়েস। মিডিয়া ও লেখালেখিতে ইমরুল কায়েস নামেই পরিচিত। প্রকাশনা: আনলাকি থারটিন অত:পর প্যারিস, রোহিঙ্গা গণহত্যা: কাঠগড়ায় সুচি, চায়না দর্শন, বিখ্যাতদের অজানা কথা; অনুবাদ গ্রন্থ: দ্য রুলস অফ লাইফ, দ্য লজ অফ হিউম্যান নেচার, দ্যা আইজ অফ ডার্কনেস। তিনি ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের পারঘোড়াদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!