আহমেদ তফিজ উদ্দিন
আহমেদ তফিজ উদ্দিন (১৯২৯-১৯৯৮) ছিলেন সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক এবং সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক।
জন্ম: আহমেদ তফিজ উদ্দিন ১৯২৯ সালে, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের তারাবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পারিবারিক জীবন: পিতার নাম আব্দুল শুকুর মণ্ডল এবং মাতার নাম ভায়না খাতুন। তিনি বাবা মায়ের বেশ আদরের সন্তান ছিলেন। বাবা মায়ের আদর্শে তিনি বড় হতে থাকেন। স্ত্রী ফিরোজা বেগম (মৃত্যু: ২০২৩ খ্রি.) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। আহমেদ তফিজ উদ্দিন ও ফিরোজা বেগম দম্পত্তির তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে আহমেদ ফিরোজ কবির পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।
শিক্ষা জীবন: নিজ গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি সুজানগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব টিচিং (বিটি) ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু
কর্ম জীবন: আহমেদ তফিজ উদ্দিন কর্মজীবনে প্রথম দিকে শিক্ষকতা করেন। পরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিরীক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকুরি করার সময় ইন্টার্ন কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন নামে করাচিতে একটি বাঙালি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিন বছর সমিতি পরিচালনা করেন এবং বাঙালিদের অসুবিধা দূরীকরণে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৩ সালে তাকে বিদেশে বদলির আদেশ দেওয়া হয় এবং বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৬৪ সালের ১ জুলাই তিনি সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এলাকার উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। উক্ত বিদ্যালয়েপ্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ভারতের কেচুয়াডাঙা ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন।
আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক আনোয়ারুল হক
রাজনৈতিক জীবন: স্কুলের ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন তিনি। রাজনীতির মাধ্যমে জনকল্যাণ করার বাসনা মনের ভেতর পোষণ করতেন। তাই তিনি দেশভাগের পরপর গঠিত মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। আহমেদ তফিজ উদ্দিন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৪৮ সালে তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৫০ সালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস ছিলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এমএনএ, ১৯৭৩ সালে ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে তিনি সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন।
আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়
ব্যক্তিত্ব: একজন সৎ রাজনীতিবিদের প্রতিচ্ছবি আহমেদ তফিজ উদ্দিন। সদালাপী, ভদ্র, সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লভ, তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামীলীগের কর্মীবান্ধব ও অমায়িক আচরণের অধিকারী ছিলেন আহমেদ তফিজ উদ্দিন। তিনি কর্মীদের ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি তার কর্মীদের বিপদে-আপদে সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের তেমনসময় দিত পারতেন না।
তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সুজানগর উপজেলার প্রায় মানুষই তার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারতেন, মনের কথা ভাগাভাগি করতে পারতেন।
অবদান: সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন তিনি। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তিনি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য জ্যামিতির ওপর তিনি পাঠ্য বই লিখেছেন, যা উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মৃত্যু: ১৯৯৮ সালের ২৮ জুন পাবনার এই জননন্দিত ব্যক্তি সুজানগর উপজেলার সর্বস্তরের জনগণকে কাঁদিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: সুজানগরের ইতিহাস, লেখক : ড. আশরাফ পিন্টু
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে