আবদুল গনি হাজারী (২য় পর্ব)
আবদুল গনি হাজারী (২য় পর্ব)
কাব্য মূল্যায়ন: আবদুল গনি হাজারীর কাব্য-প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান বলেছেন,‘‘ ‘সামান্য ধন’ অসমান্য খ্যাতি অর্জন করতে পারে নি। এই গ্রন্থে আবদুল গনি হাজারীর কাব্যকৃতি তেমন উজ্জ্বল নয় যদিও প্রথম বইতেই তাঁর কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য কাব্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু ‘সূর্যের সিঁড়ি’ প্রকাশিত হবার পরে এই কবির শক্তি সম্পর্কে কারো মনে কোনো দ্বিধা রইল না। একজন শক্তিশালী বিদগ্ধ কবি হিসেবে আবদুল গনি হাজারীর প্রতিষ্ঠিত হলেন পাঠক সমাজে।’’
তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় বাস করেছেন কলকাতা ও ঢাকা শহরে। ফলে নাগরিক-জীবনের চালচিত্র প্রধানভাবে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, “নগর জীবনের নানা অসঙ্গতি আবদুল গনি হাজারীর কবিতার বিষয়। বলবার ভঙ্গিতে সোচ্চার ব্যঙ্গ ও ভাষার সাংবাদিকতাসুলভ সারল্য সত্ত্বেও তাঁর কবিতায় যে সচেতন মনের পরিচয় বিধৃত তা পাঠককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।”
কবি আবদুল গনি হাজারী নিজের কবিতা সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত মিতবাক। নিজের কবিসত্তাকে তিনি কখনো প্রকাশ করতে চান নি অথচ তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মানুষ। তাঁর এই নির্দোষ লজ্জাবোধের মধ্যে একজন প্রকৃত কবিকেই খুঁজে পাওয়া যায়। আবদুল গনি হাজারীর তিনটি কাব্যগ্রন্থেই সমকালীন সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
আরও পড়ুন বাংলাদেশে গ্রন্থমেলার প্রবর্তক, কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন এর সাহিত্য মূল্যায়ন
আবদুল গনি হাজারীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘‘সামান্য ধন’’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। বর্তমান নাগরিক জীবনের অসঙ্গতি অনুধাবন করা যায় তাঁর এ কাব্যগ্রন্থের ‘মধ্যবিত্ত’ কবিতাটিতে-
“মধ্যবিত্ত জীবনের সুউচ্চ আশার
সংকীর্ণ কারার এই লোনাধরা প্রাচীরে
দিনে রাতে মাথা খোঁড়ে নির্বোধ বাসনা।”
সার্কাসের মেয়েদের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত বেদনার ইতিহাস। তাদের পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার খবর কেউ রাখে না। তাদের চাল-ডালের অভাব আর পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাপ-ভাইয়ের অর্থে যোগান দিতে হয় এসব দুঃখকে লুকিয়ে রেখে। হাসিমুখে অভিনয় করে যেতে হয় তাদের। যন্ত্রের মতো রেডিমেট কাজ করে যেতে হয়। তাই কবির উপলব্ধি-
“সার্কাসের মেয়েগুলোকে
মানুষের মতো নয়
একদলা জীবিত মাংসের
মেশিন বলে মনে হয়।”
(সার্কাসের মেয়েরা )
আরও পড়ুন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনন্দ বাগচী এর সাহিত্য মূল্যায়ন
এ গ্রন্থের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো ‘রামসাগর’। কবিতাটিতে যেমন চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে তেমনি ফুটে উঠেছে শ্রীমতি ভাষা-
“কয়েক’শ বছরের প্রাচীন অরণ্য থেকে
কয়েকটি বুনিয়াদি শাখা
কেন যে ভাঙতে গিয়ে সরে এলো হাত
কেন যে তাকালে তুমি সন্ধ্যা তারার মতো করে
দূরের বাঁশির মতো মধু হয়ে।”
আবদুল গনি হাজারীর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘‘সূর্যের সিঁড়ি’’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের জুন মাসে। আধুনিক সাহিত্যের জন্যে অমর একটি কবিতা রেখে গেছেন আব্দুল গনি হাজারী। ষাটের দশকে রচিত কবিতাটি, কিন্তু এতই তীক্ষ্ণ ছিল কবির চোখ ও কলম যে ৫৬ বছর পরেও সমাজের উপরতলার একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতিকৃতি হিসেবে কবিতাটি স্বার্থক হয়ে আছে। এ গ্রন্থে সংকলিত ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ কবিতার জন্য তিনি ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। আমলাদের স্ত্রীদের কণ্ঠস্বরে বিমূর্ত সত্যের মূর্ত হয়ে ওঠা এ কবিতার অন্যতম দিক। যেমন-
“আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
হে প্রভু আমাদের ত্রাণ করো
বিশ্রামে বিধ্বস্ত আমরা
কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু আমাদের স্বামীরা
অগাধ নথিপত্রে ডুবুরি
(কি তোলে তা তারাই জানে)
পরিবার-পরিকল্পনায় আমরা নিঃস্ব
সময় আমাদের পিষ্ট করে যায়
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
সকাল থেকে সন্ধ্যা
কোন মহৎ চিন্তার কিনারে
এবং ফ্যাশান পত্রিকার বিবর্ণ পাতা
দৈনিক কাগজে, সিনেমার ইশতেহার
স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের উলঙ্গ ছবি
এবং একটি প্রাপ্ত-প্রায় মহত্ত্বের শিহরণ।”
আরও পড়ুন জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার এর প্রকাশনা
আমলাদের অসীম ক্ষমতা ও অবৈধ বিত্ত বিলাসে বিভোর জীবনে স্ত্রীগণের অকারণ অর্থ বিলাসিতা, অলস জীবন ও স্বামীদের অর্থহীন ফাইল-ডুবো জীবনের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। আমলাপত্নীর শরীরের অস্বাভাবিক স্ফীত হয়ে ওঠা, অলস টাকার ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত-
“কোমরের উপত্যকায় মেদের আক্রমণ
উদরের স্ফীতি
চিবুকের দ্বিত্ব
স্তনের অস্বাস্থ্যে শংকিত
হে প্রভু আমরা
চর্বির মসোলিয়ামে হাঁসফাঁস
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
ভাঁড়ার আমাদের লক্ষ্ণী
বালিশের ভাঁজে উদ্বৃত্ত হাতখরচ
আয়নার দেরাজে হেলেন কার্টিস
এনি ফ্রেঞ্চ-মিল্ক
এস্ট্রিনযেন্ট
ডিওডরেন্ট
হ্যান্ড লোশন
রেভলন
ক্রিশ্চিয়ান ডিয়োর
এবং রুবিনস্টিন
অবশ্য স্বামীদের কাছ থেকেই
উষ্ণ প্রেমের ঘাটতি
প্রৌঢ় ক্ষতিপূরণ”
আমলাদের বিত্তবন্দি জীবনে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাকে উগ্র আধুনিক প্রসাধনীর মোড়কে আটকে দেওয়ার চিত্র-
“আর্দালীর কুর্নিশে গর্বিত
স্বামীরা অফিসে সর্বক্ষণ
অন্যের পদোন্নতির বাধা
দরখাস্ত নাকচ
এবং কতিপয় পদস্থ দস্তখত
বাড়ি ফিরেও হায়
বন্ধুর প্রমোশনে ঈর্ষিত
বেনামি ব্যবসার লাভক্ষতি
তারপর টেলিফোন
তারপর টেলিফোন
তারপরও টেলিফোন
মাদের ঠোঁটের রেভলন
মুখের ফাউন্ডেশন
কপালের সযত্ন টিপ
শুকিয়ে আসে
বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি।”
আরও পড়ুন আমাদের সুজানগর সংকলন রিভিউ
আমলাদের অকারণ ব্যস্ততায় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি ও ঘাটতিজনিত কারণে কখনো স্ত্রীদের জীবনে পুরাতন প্রেমিকের উপস্থিতি বা দ্বিতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা-
“অতঃপর হে প্রভু
দ্বিতীয় ব্যক্তির চিন্তা
আমাদের উন্মনা করে যায়
পুরাতন প্রেমিক বিবাহিত
তরুণদের মাসি
সাবর্ডিনেটের আম্মা
বোনের সংসারে নানি।’
এবং বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি’
আমলাদের স্ত্রীদের শেষমেশ কর্মহীন জীবনের হাহাকার-
“আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু
যে-কোনো একটা কাজ দাও
নিজেদের নিক্ষেপ করি
তার গহ্বরে।”
এ কবিতা ছাড়া এ গ্রন্থে রয়েছে ‘মিসেস ডিয়োরের মন’, ‘পি আর এম স্টিমার : গোয়ালন্দ’, ‘কোন বন্ধুর পুত্রের মৃত্যুতে’,‘ক্যান্টন’, ‘একটি আরবি গানের প্রেক্ষিত’, ‘সেই লোকটি’, ‘সূর্যের সিঁড়ি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কবিতা। এসব কবিতায় আবদুল গনি হাজারীর কবিতার বৈশিষ্ট্য, বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি ও কবিতার স্বাতন্ত্র্যবোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন আবদুল গনি হাজারী-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আবদুল গনি হাজারী (২য় পর্ব)