আনোয়ারুল-হক
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  নিশ্চিন্তপুর,  ভাষা সৈনিক,  সাতবাড়িয়া,  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

আনোয়ারুল হক

পাবনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক, ভাষা সংগ্রামী ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আনোয়ারুল হক ছিলেন সৎ ও আদর্শ সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত।

জন্ম: সাংবাদিক ও ভাষা সংগ্রামী আনোয়ারুল হক ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক জীবন: পিতা তাজউদ্দিন আহমেদ (বিএ) ব্রিটিশ আমলে কলকাতা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। মা আমিরুন নেছা ছিলেন গৃহিণী। সাবেক ছাত্রনেতা নজমুল হক নান্নু এবং পাবনা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক এম সাইদুল হক চুন্নু তাঁর ছোটো দুই ভাই । তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ছেলে সুশোভন হক টুটুল পাবনার সাবেক  ক্রিকেটার।

শিক্ষা জীবন: আনোয়ারুল হক নিশ্চিন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পাবনার রাধানগর মজুমদার (আর এম) একাডেমী থেকে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর পাবনা কলেজ থেকে বিএ সম্পন্ন করেন।

আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়

কর্ম জীবন: আনোয়ারুল হক ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনাইটেড ব্যাংকে চাকুরীর মাধ্যমে  কর্মময় জীবন শুরু করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের  পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সরকার ইত্তেফাক বন্ধ করে দিলে, কিছুদিন দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদে কাজ করেন। পরে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে থেকে আবার সৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। তিনি অর্ধ-শতাব্দীর অধিক সময় সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য নিভৃতে কাজ করে গেছেন। তিনি একাধিকবার পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।  পাবনা জেলায় সাংবাদিকতার দ্বার উন্মোচনে যাঁদের নাম স্মরণীয় বরণীয় হিসেবে উচ্চারিত হয়, তাঁদের মধ্যে আনোয়ারুল হক ছিলেন অন্যতম। একজন ব্যাংকার হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন বহুকাল। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার হিসেবে  অবসর গ্রহণ করেন।

সংগ্রামী জীবন: আনোয়ারুল হক নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে মিছিল করেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সাত দিনের জন্য কারাবরণ করতে হয়েছিল।  ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে নূরুল আমীন বিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সরকারিভাবে আমদানিকৃত বিষাক্ত ভুট্টা খেয়ে পাবনার সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তিনি আইয়ুব সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করেন। সে সময় ভুট্টা আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে পাবনার অনেক আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আনোয়ারুল হককেও গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেলেও তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ফলে দুই বছর তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মৃত্যুর মুখেও আনোয়ারুল হক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসি ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সর্বক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী পাবনা জেলা শাখা প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির জীবন সদস্য এবং জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, পাবনা জেলা শাখার সদস্য হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

সম্মাননা:  ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ২রা মে পাবনা প্রেসক্লাবের ৫৬ বছর পূর্তিতে প্রবীণ সাংবাদিক রনেশ মৈত্র ও আনোয়ারুল হককে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা-সম্মাননা দেওয়া হয়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন আনোয়ারুল হক। প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার বছর ৮-৯ই মে পাবনায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলন। সেই সভা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সমিতি, যা বর্তমানে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি হিসেবে পরিচিত। পাবনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সেদিন সংবাদপত্রে মফস্বলে কর্মরত সাংবাদিকদের পেশার স্বীকৃতি ঘটেছিল। যাদের হাত ধরে এই স্বীকৃতি, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আনোয়ারুল হক।

আরও পড়ুন সাংবাদিক ও লেখক ইমরুল কায়েস

মৃত্যু: ভাষাসৈনিক আনোয়ারুল হক বার্ধক্য জনিত কারণে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন।  তিনি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি, বুধবার রাত ১টা ৫ মিনিটে পাবনা শহরের শালগাড়িয়া মহল্লার নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তাঁকে পাবনা সদর আরিফপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।

আনোয়ারুল হক ছিলেন সততা আদর্শিক সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ।  তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ ব্যক্তি, আদর্শ মানুষ ও আদর্শ সাংবাদিক। পাবনার সাংবাদিকসহ সকল মানুষ তাকে চিরদিন স্মরণ করবে।

তথ্যসূত্র:

১। পাবনায় ভাষা আন্দোলন, ড. এম আবদুল আলীম

২। দৈনিক ইত্তেফাক

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

আনোয়ারুল হক

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!