আনন্দ বাগচী (শেষ পর্ব)
আনন্দ বাগচী (শেষ পর্ব)
আধুনিক কবিতা অর্বাচীন এবং নির্বচনীয়, ভ্রান্তিকর এবং শ্রান্তিকর এবং উদ্ভট – এমন বিদ্রুপাত্মক লোকশ্রুতি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। অথচ কবিতা অব্যয় এবং কবিতা যে ফুরিয়ে যায়নি, তার যে আরো অফুরন্ত অনুশীলনের অবকাশ রয়েছে, এই কথা জানান দেবার ইচ্ছা সেই সময় থেকেই জেগেছিল।… পরে কলকাতা থেকে দূরে চলে গিয়ে স্মৃতিজীবী কলকাতাকে আরো নতুন আভাসে দেখতে পেলাম। গদ্য উপন্যাসে এদের চিত্রিত করতে গিয়ে মন তৃপ্ত হল না। ব্যক্তিগত বেদনা এবং নিঃসঙ্গতার আবেগ, কবিতা বা গানের চেয়ে আর কিছুতেই ভালো ফোটে না। সেইজন্যেই স্বকালপুরুষ-এর সৃষ্টি।’
এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে (প্রকাশক মহাদিগন্ত)। রানীবালা আর নিখিলেশের অমৃতে গরল আর গরলে অমৃতের কাহিনি নিয়েই তো এই স্বকালপুরুষ। আমাদের বাংলা সাহিত্যে এরকম কাব্যোপন্যাস খুব একটা রচিত হয়নি। এমনিতেই তো আমাদের কাব্যোপন্যাসের সংখ্যাও তো তেমন কিছু নয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, আমাদের কবিদের কাছে, এখনো পর্যন্ত, সাহিত্যের এই ধারাটি প্রায় অপরীক্ষিতই রয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাঁকুড়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে তাঁর সেই কলকাতাতেই ফিরে এসেছিলেন আনন্দ বাগচী। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সতেরো বছর তো আর কম দীর্ঘ সময় নয়! কলকাতায় ফিরে এলেও, মনে হয়েছে, তিনি তাঁর জীবনের কলকাতা পর্ব যেন অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। যে কারণে শারীরিকভাবে ফিরলেও মনোগত দিক দিয়ে আর ফিরতে পারেননি। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই কবির বয়সও তো হয়েছিল। প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকে; যার পরে, সেই ‘না শুরুর পর্ব’ থেকে নতুন করে আর কিছুই শুরু করা যায় না। লুপ্তপ্রায় সংযোগকে নতুন গতিপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যর্থতা, কবি আনন্দ বাগচীও, যেন তাঁর সমুচিত বাস্তব-বোধ থেকেই মেনে নিয়েছিলেন, ‘কলকাতায় ফিরে এসেছি কিন্তু এখনো আমার না লেখার পর্বই চলেছে। ইতস্তত কিছু খাপছাড়া গদ্যে কলম জ্বালিয়ে রাখলেও মন তৈরী হয়নি এখনও। যতদূর তাকিয়ে আছি কবিতার চিহ্নও নেই।… নতুন বিষয় নতুন মাধ্যম খুঁজছি, পাচ্ছি না, পাবো কিনা তাও জানি না। সেই বয়স সেই আবেগ হারিয়ে গেছে।’
আরও পড়ুন লেখক ও অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন
কবিতা রচনার নামে ব্যক্তিপুরুষের আত্মানুভূতির নিছক যান্ত্রিক প্রকাশ ও পুনরাবৃত্তি তাঁকে প্রলোভিত করেনি। সেই কারণেই কবির অহংকার নিয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘কবিতায় বন্ধ্যাদশা এর আগেও একাধিকবার এসেছে… আবার কোনো নতুন ধ্বনি, নতুন প্রেরণা হয়তো হঠাৎই এসে যাবে… হয়তো আদৌ আসবে না, তবু প্রতিধ্বনি আর নয়।’ (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৭)
নমনীয় রূপবন্ধে জীবন মৃত্যুর সামঞ্জস্যতাকে মেনে নেওয়ার সক্ষমতাও আনন্দ বাগচীর ছিল-
“যাওয়া খুব সহজ এখন…
দিনান্তে আয়নার দিকে চেয়ে মনে হয়
সামান্যই পরমায়ু…
চুকিয়ে দিয়েছি সব দাম।
যাওয়া খুব সহজ এখন
চোখের একফোঁটা জলে জমে আছে শেষ বিস্মরণ। ”
যে কবি এমনটি বলতে পারেন, ‘আমি আমার চোখ দিয়েই দেখি, আমার মত করেই লিখি। সেই দৃষ্টি ক্ষীণ হতে পারে, সেই লেখা অক্ষম হতে পারে কিন্তু তা একান্তই আমার নিজস্ব’ – কেবল তাঁর পক্ষেই এমন একটি স্বনির্ভর শর্ত দ্বিধাহীনভাবে মেনে চলা সম্ভব ছিল। কবি আনন্দ বাগচী আমৃত্যু তাঁর নিজের সেই ব্রত আঁকড়ে ধরেছিলেন।
আনন্দ বাগচীর কবিতায় জীবনানন্দীয় ইন্দ্রিয়বেদত্তা লক্ষ্য করা গেলেও তাকে হয়ত সুররিয়ালিস্ট তকমা দেওয়া যায়না বরং বোধের চেয়েও সেখানে পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে লেগে থাকা সচেতন চিত্ররূপময়তা মায়াবী জাদুবলে পাঠককে ধরে রাখে। ছবি প্রসংগে যামিনী রায়কে লেখা চিঠিতে একবার রবীঠাকুর লিখেছিলেন-“ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারে আমাদের জীবনের উপলব্ধি। এজন্য তার একটি অহেতুক আনন্দ আছে। চোখে দেখি- সে যে কেবল সুন্দর দেখে বলি, খুশি হই, তা নয়। দৃষ্টির ওপরে দেখার ধারা আমাদের চেতনাকে উদ্রেক করে রাখে। সে রূপের রেখা এড়াবার জো নেই। যা মনকে অধিকার করে নেয় কোন একটা বিশেষত্ব বশতঃ তা সুন্দর হোক বা না হোক, মানুষ তাকে আদর করে নেয়। তার তার চারদিকের সৃষ্টির ক্ষেত্রকে পরিপূর্ণ করতে থাকে।”
আরও পড়ুন কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন
আনন্দ বাগচীর প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই আমরা এমনই একটা করে দেখার প্রেক্ষাপট দেখতে পাই। তার চারপাশের সমস্ত পার্থিব সমস্ত প্রকৃতিকে কবি যে কেবল নিরীক্ষা করেছেন তা নয় বরং স্থল জল অন্তরীক্ষের একটা সম্পূর্ণ ক্যানভাস যেন তার বেশিরভাগ কবিতার পান্ডুলিপি হয়ে ঊঠেছে। এক একটা ছবি যার দৃশ্যগুণ কেবল সময়ের নয় বরং আবহমানের দরখাস্ত জমা করে গেছে পাঠকের হাতেও। “স্যানিটোরিয়ামের চিঠি” কবিতায় আনন্দ বাগচী লিখলেন-
“পনের নম্বর বেড খালি হল। আটমাস পরে আজ রাতে
বিছানা সরানো হলো,চ্যাপ্টা, বেঁটে ওষুধের শিশি
মেজার গ্লাসের পাশে সারি সারি সাজানো, শিয়রে
রিপোর্ট টেবলখানা, এখনো রয়েছে, কাল ভোরে
সমস্ত অদৃশ্য হবে, সাদা একটি চাদর বিছিয়ে
মৃত্যুকে আবার ঢেকে দেওয়া হবে, নতুন মানুষ বাসা বাঁধবে। ”
আবার “অন্যমনে” কবিতায় তিনি লিখলেন-
“পড়েছ অস্ফুট ছায়া মুখে চোখে পিছল বুকের
ঘাটে ঘাটে, যৌবনের বেলা যাচ্ছে কাজলা দীঘির
জল কাঁপছে থিরথিরিয়ে , জলে ঢেউ দিও না, দিও না,
দোলন চাঁপার মত একটি সুখের
ছায়াকে ভেঙ্গো না তুমি এই পাতাঝুরির শিশির ।”
জীবন থেকে মৃত্যু সমস্ত রংগুলোকেই যেন যত্ন করে অক্ষরে বিন্যাস করেছেন আনন্দ বাগচী। তাঁর কাব্যের নিবিড় পাঠে আমরা এক ধরনের প্রতীকবাদ লক্ষ্য করতে পারি যেখানে কবি গন্ধকে স্পর্শে স্পর্শকে দৃশ্যে দৃশ্যকে শব্দে শব্দকে ধ্বনিতে পরিনত করেছেন অনায়াসে, যার ফলে অক্ষরের মাঝে উঠে আসে দৃশ্যের প্রত্যক্ষতা। প্রতীকের মধ্যে দিয়ে তিনি যে জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন সেখানে রয়েছে অনুভূতির বিপুলতা; আর এই দৃশ্যান্তরের শেষে এসে পাঠকও যেন জীবনের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার রসদ খুঁজে পায়; শুরু হয় কবিতার পুনরুজ্জীবন।
আরও পড়ুন লেখক এম আকবর আলী
শেষ পরিণতি: ত্রিলোচন কলমচী বা শ্রীহর্ষ ছদ্মনামে যিনি লিখে গেলেন একের পর এক নিবন্ধ কিংবা ‘কানামাছি’, ‘মুখোসের মুখ’, ‘বনের খাঁচায়’, ‘চকখড়ি’ র মত একাধিক উপন্যাস এবং যিনি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার অন্যতম কিংবা দীর্ঘদিন ‘দেশ’-এর মত বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন সেই আনন্দ বাগচীকেও আমরা মিশে যেতে দেখলাম সমকাল থেকে শূন্যে। অর্থাৎ শাশ্বত বলে সত্যিই কিছু নেই। অনেকের ধারণা ‘বিস্মৃতি’ নামের শব্দটা লিটিল ম্যাগের লেখক কবি কিংবা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদেরই একমাত্র ললাট লিখন কিন্তু আনন্দ বাগচীর মত প্রাতিষ্ঠানিক একজন বহুকলমীর ধীরে ধীরে একটানা জ্বলতে থেকে আকস্মিক ফুরিয়ে যাওয়া যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় ক্ষণকালের জড়ত্ব অতিক্রমী কেউই নন।
পাবনার সুজানগর উপজেলার হাটখালী ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্ম তাঁর আর মৃত্যুর সময় ছিলেন ওপার বাংলার হালিশহরে। আশি বছরের সামগ্রিক জীবনে এপার ওপার দু বাংলারই আজ হয়ত কেউ কেউ তাকে ঔপন্যাসিক কিংবা জমজমাট কিশোর সাহিত্যশ্রষ্ঠা হিসেবে কখনও সখনও স্মৃতিচারণা করেন, কিন্তু কজন মনে রাখেন এই আনন্দ বাগচীর সাহিত্য জীবনের শুরু কবিতা দিয়েই ! বাংলা কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে কজনই বা উদ্ধ্বৃত করেন তাঁর অমোঘ পংক্তিদের! যেখানে আঁকা আছে একটি একা মানুষের ছবি , যে রাত জেগে পড়া করে লন্ঠনের স্তিমিত আলোয় আর পাখির বাসার মত ঘরে লুকিয়ে রাখে অস্তিত্বের চিরকালীন অনুনাদগুলি।
আরও পড়ুন কবি আদ্যনাথ ঘোষ
হয়ত আনন্দ বাগচীর বিস্মৃতপ্রায় এসব কবিতার কাছেও যোগ্য পাঠক ফিরে ফিরে আসবে একদিন নতুন অনুসন্ধান নিয়ে নতুন পূনর্মূল্যায়ন নিয়ে। হয়ত সেদিন ভুল প্রমানিত হবে কবির নিজেরই পংক্তি-
“তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে
কেউ আসবে না,বোকা,
কেউ কি নিজের কাজ ফেলে
খেয়ালের কথা রাখে ?”
আরও পড়ুন আনন্দ বাগচী
১ম পর্ব
২য় পর্ব
চকখড়ি উপন্যাস রিভিউ
তথ্যসূত্র:
✔কালি ও কলম, বাক পত্রিকা, মিলনসাগর
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আনন্দ বাগচী (শেষ পর্ব)