আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় প্রান্তিক প্রতিধ্বনি
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় প্রান্তিক প্রতিধ্বনি
জহুরুল ইসলাম
কবিদের কোনো সীমারেখা নেই। কবি সব দেশের, সব মানুষের, সব জাতির। কবি মানুষের কথা বলে, মানবতার কথা বলে। কবি তার গোপন আয়নায় দেখতে পান- সমাজের অসঙ্গতি, পতন, ঔদ্ধত্যের বিকৃত রূপ, অনাচার। তিনি কারও সঙ্গে আপস করেন না, করেন না। কোনো গোপন চক্রান্ত। তিনি গোপনে গোপনে ক্রমাগত মোচড় খেতে থাকেন। একদিন তিনি সব গোপন সত্য আয়নায় প্রতিফলিত করেন। তিনি প্রকাশ করেন- কারণ না করে তিনি থাকতে পারেন না। কবি আদ্যনাথ ঘোষও এর ব্যতিক্রম নন। তার ব্যথিত হৃদয় বারবার কেঁপে ওঠে স্বদেশের ভাবনায়-
তাতার ঘোড়ার পিঠে ছুটেছে
নাগরিক স্থাপত্যবিদ্যার যোদ্ধাকুল
পতন হচ্ছে গাঁয়ের পর গাঁ তার হাতে
গ্রাম খেকো অজগর দেখাচ্ছে সে যেন
কলিমুল্লার সাপখেকো সেই অলীক লাঠির বাহার…
( শঙ্কা : ভোরের পাখি )
আরও পড়ুন আমাদের সুজানগর সংকলন রিভিউ
আজ মানুষ বড় স্বপ্নাচ্ছান্ন। নক্ষত্রের পানে চেয়ে আঁধার রাতে ঢেউয়ের মাথায় অনবরত নৃত্য করে চলেছে। বর্তমান সময়ের মানুষ বড় স্বর্থপর, তার কারণও আছে- তারা সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ। দুঃসাহসিক আকাঙ্ক্ষায় ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারের তলায়। সে কী পতন! কী যে দুঃখ! কী যে যন্ত্রণার! তা কি কেউ বোঝে? বোঝে, তবু অবুঝের মতো মানুষের পথচলা । যখন আশাহীন মানুষের চোখ জলে ভরে ওঠে, তখন তার স্বপ্ন বলে আর কিছু থাকে না। ম্রিয়মাণ আলোটুকুও যেন শেষ বেলা এসে নিভে যায়। সে কথাই আদ্যনাথ ঘোষ জানিয়েছেন-
অথচ বুকের মধ্যে জমে ওঠে সোনালি বয়ানের ঘুমজাগা পাখি
প্রতিশ্রুতির পাখনায় ভেসে চলা গাঙচিল, রোদ্রালি আকাশ।
দুর্দশার ঘনঘোরে মাঠে ক্ষতচিহ্নগুলো চোখে ভেসে ওঠে
বুকচাপা দীর্ঘঃশ্বাস ঘরের ভেতর
শুধুই হাপিত্যেশ করে- বুকের ভেতর ক্ষত জমা হয়-
মেঘেরা দল বেঁধে নামে- ছুঁয়ে যায় মধ্যরাত-
অশ্রু ফেলে অনুতাপ, জেগে থাকে বিরান অন্তর…
(স্বপ্নভঙ্গ : তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে )
সাহিত্যে অভিজ্ঞতার দরকার। কিন্তু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাহিত্যেকের খুব অভাব আছে বলে মনে হয়। একেবারে যে নেই তা নয়, আছে। যাদের দ্বারা আমরা সাধারণ পাঠক প্রভাবিত হই। কবি আদ্যনাথ ঘোষ তেমনি এক কবি।
আরও পড়ুন আনন্দ বাগচীর চকখড়ি উপন্যাস রিভিউ
প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা এ কবি প্রকৃতির স্মৃতি বুকে ধারণ করে সময়ের সঙ্গে বয়ে চলেছেন। শ্যামল প্রকৃতি তার সঙ্গে যেন কথা কয়। কবি আদ্যনাথ ঘোষের হৃদয়ে আছে দেশের প্রতি জমাট ভালোবাসা, সেটা তার কবিতা পাঠ করলেই অনায়াসে বুঝা যায়। তার হৃদয়ের আরশিতে মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে, সে গন্ধে তার হৃদয়টা সর্বদা ভরে থাকে। প্রকৃতির প্রতিটা প্রহর, দিন তার বুকে ঢেউ তোলে। ভোরের নীলাকাশে উথলে ওঠা আলোয় জেগে ওঠে নতুন প্রত্যাশা। তার চোখে যেন ভেসে ওঠে কৃষকের হাসিমাখা মুখ, আর শিশির ভেজা ফসলের নরম শরীর। কবি আপন সত্তাকে প্রকৃতির মাঝে বিলীন করে দিতে চান। হতে চান চির সবুজ, ফুলের মতো পবিত্র আর নদীর মতো উচ্ছল। তিনি মাঝেমধ্যে আকাশের মতো উদার হতে চান, হতে চান প্রকৃতির মতো সহজ। তিনি সব দুরাশাকে পায়ে ঠেলে থাকতে চান এ মাটির কাছাকাছি। তবুও তার বুকের ভেতর কোনো এক অহেতুক আশঙ্কা ঠেলা মারে-
রাতের শরীর পেঁচিয়ে নামে প্যাঁচার কণ্ঠস্বর আর মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
করীরের উষ্ণতা হিম হয়ে ঠিকানা খোঁজে হিমাগারে
নির্ঘুম স্মৃতিরা উড়াল দেয় বেনামী বন্দরে চোখ মেলে চেয়ে দেখে-
কালো ছায়ায় ভরা আকাশ আর অনন্ত নক্ষত্রবিথি…
(রাত্রির গান : একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর )
বিচিত্র মানুষের মনের ভাবনার জগৎও বিচিত্র। চিন্তায়, চেতনায়, ভাবনায়, মননে লেখকরাই অন্য সব মানুষের থেকে একেবারে আলাদা। তারা সবার সঙ্গে চলেও সব মানুষের থেকে ভিন্ন। তাদের রয়েছে আলাদা এক বিশাল জগৎ। যে জগতের সন্ধান কেবল লেখকরাই জানেন। সে জগতে চলে নানামুখী ক্রিয়াকলাপ । সে ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে একদিকে যেমন সমকালের
ভেতর দিয়ে গমন করেন। অন্যদিকে মহাকালের ভিতর দিয়েও গমন করতে পারেন। আর তখনই তিনি হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ।
আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্পগ্রন্থ ‘মায়াকুসুম’ রিভিউ
কবি আদ্যনাথ ঘোষের হৃদয়ের গহ্বরে অপার আকাঙ্ক্ষার স্বচ্ছ ঝরনাধারা অবিরাম বয়ে চলেছে। তার এ বয়ে চলা নিরন্তর। এ নিরন্তর পথচলায় দুরন্ত যৌবনে হৃদয়ের আশাগুলো আলোর শিখার মতো বিস্তৃত হয়। কখনও কখনও অমঙ্গলের আশঙ্কায় এ কবির হৃদয় বেদনায় ঢেকে যায়-
অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে
অনেক সাধের স্বপ্নগুলো
উড়ে গেলো কপূরের মতো
বুঝতে পারিনি আমি।
এখন শুধুই ধূপের মতো জ্বলেপুড়ে
ভাতের নির্জনে
নিঃশেষ হয়ে যাই ধূলি ধূসর
গভীর অন্ধকূপে।
( নিঃশেষ : বিধিলিপি মন )
সাহিত্য সমাজের ছবি। এ ছবিতে ফুটে ওঠে নান রকম চলমান ঘটনা আর দুর্ঘটনা, যা সমাজের অন্য সাধারণ মানুষের চোখে সচরাচর ধরা পড়ে না। অথচ একজন লেখকের কাছে তা জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। লেখক কোনো কিছুকে উপেক্ষা করতে পানে না। সেটা যত ভালোই হোক অথবা মন্দই হোক।
কবিতা সবার হাত আসে না, কারও কারও হাতে আসে। কবিতা আসে হেমন্তের হলুদ সর্ষে ক্ষেতের চঞ্চল হাসি নিয়ে। নয়তো রক্তভেজা বুকে কালো কাপড়ে মুখ বেঁধে । সমসাময়িক কালে আদ্যনাথ ঘোষের হাত ধরে কবিতা আসে উভয়রূপেই। তার কবিতার শরীরে একদিকে ঝলসে ওঠে অপরূপ রূপ, অন্যদিকে চুইয়ে পড়ে লাভার আগুনের মতো যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণাই তাকে ঠেলে দেয় রহস্যময় বৈচিত্র্যের জগতে। রহস্যময় বৈচিত্র্যের জগৎই কবিতা। এর একদিক ধরে টান দিলে মাকড়সার জালের মতো সব দিকে টান পড়ে।
আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদদীনের গল্পগ্রন্থ নয়ান ঢুলী রিভিউ
কবিতার মায়াবি জগতে কেউ একবার আটকে গেলে সে আর কোনোদিন বের হতে পারে না। এ যেন জাদু, এ এক পাগলামি। এ শিল্পে আছে সত্যের শাসন। এ শাসনেই তারা পথ হাঁটেন। হাঁটতে হাঁটতে কবি উপলব্ধি করেন-
যে আঁধার মিশে গেছে জীবনের বসন্তবেলায়
মাঠভরা ফসলের চোখে, অঘ্রাণ প্রান্তরে,
আকাশ বাতাস আর নদী মাঠ সমুদ্রের ক্ষতে।
সে কী আর আলোর দীপাবলি উৎসবে
আসবে কী…
( উপলব্ধি : তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে )
আদ্যনাথ ঘোষ বহুদূর নক্ষত্রের মতো বিহ্বল। একাকী পথ ধরে হেঁটে চলেছেন এ কবি। হাঁটতে গিয়ে তিনি অনেকটাই ক্লান্ত। তার এ ক্লান্তি যেন মনেই বেশি। তিনি দেশের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে চান। কাকডাকা ভোরের সোনালি রোদ্দুরে কৃষকের হাসিমাখা মুখ দেখতে চান। তার জীবনের সমস্ত যৌবনে কাজ করে চলেছেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য। তাই তিনি চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষায় থাকেন বহতা নদীর ধারে, শীতল হাওয়ায়। তার মন তৃষ্ণায় কেঁদে ওঠে, বাড়ে প্রাণের ব্যাকুলতা, ওঠে উষ্ণতার কথা। নদীর ঢেউয়ের মাথায় জলছবি হয়ে ভেসে ওঠে লাবণ্যলতা। এই তো আশা, এই তো প্রাণের জোয়ার, এখানেই ভরসা। কিন্তু অন্যপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখেন- অশুভ আত্মার সর্পিল ফণা।
আরও পড়ুন পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রিভিউ
তখন কবি ঈশ্বরের কাছে প্রর্থনায় বসেন- পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য, যাতে পৃথিবী জেগে ওঠে নতুন প্রাণের সজীবতায়। কবির প্রতিটা কাব্যগ্রন্থে মাতৃভূমির প্রতি গভীর মায়া ও দুর্বলতা প্রতিফলিত। তার কবিতা পাঠ করলে দেশের প্রতি তার এক অনিবার্য টান অনুভব করা যায়। দেশের প্রতি রয়েছে তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। মানুষের প্রতি রয়েছে অগাধ মমত্ববোধ। তিনি যেন দেশ, মানুষ ও প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধ। নানান প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি একজন শিল্প সচেতন কবি। তার কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে কল্পনা, স্মৃতি, বিস্ময়, স্বপ্ন তেমনি অন্যদিকে রয়েছে দেশ, মানুষ ও প্রকৃতির কথা-
জোছনার সফেদ ফেনা, হৃদয়- রোদ্দুরের উঠোনে
রূপের ঝলকিত তুফান আর যতো সবুজের রং
সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে- সবকিছু ডালায় সাজিয়ে
ফুলের জীবনের উতলা পৃথিবীকে জাগিয়ে
আমার বুকে যত রঙিন ভোর,
আমার স্মৃতিতে যত উন্মুখর প্রণয় আর
যা কিছু দখিনা বাতাসের চোয়ার…
(বসন্ত : একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর)
স্বপ্নভঙ্গ কবিতায় কবি মানুষের স্বপ্নের কথা, প্রতীক্ষার কথা, আশার কথা আর নিরাশার ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন মানুষের বুকের গভীর ক্ষতের কথা। কারণ সে ক্ষতচিহ্নগুলো কবির চোখে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। তিনি অনুভব করেন তাদের বুকের দীর্ঘশ্বাস। তাদের বিরান অন্তরজুড়ে জেগে থাকে অনুতাপ, যা কবিকে চরমভাবে ব্যথিত করে।
আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের তারা পরিচিতি রিভিউ
কবির কবিতা সরলভাবে হৃদয়ে গেঁথে যায়, যা পাঠকের অনুভবকে নাড়া দেয়। তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে প্রেম, চেতনা, দেশ, প্রকৃতি। বাংলা ভাষার এ শিকড়সন্ধানি কবি তার শিল্পিত মনে খুঁজে বেড়ান নদী, মাঠ, জল, বাতাস-
অথচ অরণ্য কাঁদে
সবুজের ধ্বনিময় বুকভরা ফসলের কোলে।
স্মৃতিগুলো অতৃপ্ত রয়, ভেসে উঠে সেফটিফিনের ফোঁড়
সূর্যের উচ্ছ্বাসে সবুজের গন্ধ জলে
দহনে ভরে উঠে ভরণ কলস, ঘোরের আকাশ…
(জলচোখ : তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে)
কবি আদ্যনাথ ঘোষ সুন্দরের টানে সচেতন হৃদয় নিয়ে ছুটে চলেছেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে।
আরও পড়ুন আদ্যনাথ ঘোষ-
আদ্যনাথ ঘোষ
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতার সাহিত্য রস
দূর জংলার গান : ভাব ও রূপকল্পের অন্বেষণ
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় প্রান্তিক প্রতিধ্বনি