অন্তর্দাহ
অন্তর্দাহ
রাতুল হাসান জয়
মরুভূমিতে একা হাঁটছি। যেদিকে তাকাই মনে হচ্ছে বিভীষিকাময় অন্ধকার, পা ফেলতেই মনে হয় আমি গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছি। একটু এগিয়ে যেতেই পা ভিজে যাচ্ছে রক্তে। নিচে তাকাতেই দেখি মুহূর্তে দৃশ্যপট বদলে গেল। মরুভূমি ছাপিয়ে সমুদ্রের মাঝে বসে আছি একাকী ডিঙি নৌকায়। হাতের কাছে না আছে কোনো লাঠি, না বৈঠা। স্রোতে ভাসছে নৌকা, দুলছি আমিও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো দমকা বাতাস। সমুদ্রের বুক ঠেলে উঠে এল তুফান। মরুর বুক থেকে সমুদ্রের বুকে কীভাবে এলাম! তা ভাবার আগেই হঠাৎ উলটে গেল নৌকা। আমি ডুবে যাচ্ছি! দম বন্ধ হয়ে আসছে। দুচোখ আর হাত খুঁজছে নূন্যতম বাঁচার আশা। কিন্তু উত্তাল সাগরে আমি তলিয়েই যাচ্ছি।
ঠিক এমন সময় লাফিয়ে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই সবার আগে মাথার ওপর পাগলের মতো ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে চোখ যায়। তা স্বত্তেও আমি ঘেমে একাকার। গলা শুকিয়ে আটকে যাচ্ছে নিশ্বাস। যেন যমের মুখ থেকে ফিরে এলাম।
“আচ্ছা। তা আপনি কতদিন ধরে দেখছেন এমন স্বপ্ন?”
“এই ধরুন সপ্তাহ চারেক হবে।”
“প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সারাদিনের কাজ, নানান ভাবনা; এসব থেকেই সম্ভবত এমন স্বপ্ন দেখছেন। তাছাড়া আপনি সম্ভবত লম্বা সময় ধরে ঠিকমত ঘুমান না।”
“শুরুতে আমিও তাই ভেবেছিলাম। ঘুম হচ্ছে না হয়তো সেজন্যই এমন স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু বিষয়টা যদি এমন হতো তাহলে আপনার কাছে আসতাম না; বিশ্বাস করুন।”
“তাহলে?”
আরও পড়ুন গল্প গয়নার নৌকা
“গত শনিবারে যখন একই স্বপ্ন দেখলাম পানিতে ডুবে যাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটু নিশ্বাস নেওয়ার আশায় যখন ছটফট করছি, হাতড়ে কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি; ঠিক তখনই একটা মেয়ে আমায় টেনে তোলে। এসব স্বপ্ন অবচেতন হলে বলতাম অপরিচিত কেউ সে মেয়ে। কিন্তু মেয়েটা আমার পরিচিত। আমি ওকে স্টুডেন্ট লাইফ থেকে চিনি। হাউজ টিউটর ছিলাম ওর। যেদিন ও আমাকে টেনে তুলল ডুবে যাওয়া থেকে, সেদিন থেকে আর এমন কোনো স্বপ্নই দেখছি না আমি।”
“মাত্র বললেন এসব স্বপ্ন দেখছেন, আবার এখন বলছেন দেখছেন না। আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথা।”
“আমি প্রথমে প্রতি রাতে প্রায় ডুবে যাওয়াই দেখতাম। কিন্তু সে আমাকে হাত বাড়িয়ে টেনে তোলার পর থেকে বিশ্বাস করুন, আর এমন স্বপ্ন দেখি না।”
“থামুন, থামুন। যখন আর এমন স্বপ্ন দেখছেনই না, তাহলে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন কেন?”
“সমস্যা তো সেখানেই৷ স্বপ্নে আর না দেখলেও, সে এখন আমার জীবনে বাস্তবে পায়চারি করছে। আমি হঠাৎ হঠাৎ তাকে দেখতে পাই আমার চারপাশে। কখনও আমার ঘরের বারান্দায়, কখনও বা আমার একাকী সময় আমার ইজি চেয়ারে দোল খায়। আমি এখন প্রায়ই তার শরীরের ঘ্রাণ পাই, আমার সারা ঘর জুড়ে। ঘ্রাণ পাই আমার শার্টে, সময় অসময়ে আমার আশেপাশে। শুধু তাই নয়, ঘরের মেঝেতে ভুল বানানে বেশকিছু চিঠিও পেয়েছি আমি। আর আমি জানি এসব তারই লেখা।”
“মানে? কী অদ্ভূত কথা বলছেন, সবুজ সাহেব?”
“আমার নিজের কাছে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে ডক্টর। কিন্তু দেখুন, আ…আজ সকালেরই ঘটনা এটা। আজ সকালেই সে এই মোড়ানো টুকরো কাগজে চিঠি লিখে ফেলে গেছে। দেখুন।”
বেশ কৌতূহল নিয়ে ডাক্তার চিঠিটা হাতে নিলেন। মোড়ানো ভাঁজ খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন তিনি।
আরও পড়ুন গল্প আলতা বানু
মাস্টারদা,
একদিন আপনাকে বলব ভূত আর ভবিষ্যৎ সবটাই প্রেমিকার মতো। আপনার করানো অঙ্কের চেয়েও দ্রুত আপনার চোখের আড়াল বুঝতে পারি।
অথচ আপনি…
থাক আর কথা বাড়াব না মাস্টারদা। চলে যাবেন যান। এতটুকু জেনে যান, মেয়েদের মনে একবার যে মানুষটা বসে যায়। সে থেকে যায়। দেখা না হতে হতে হয়তো চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যায়। তবু হঠাৎ…
অসমাপ্ত চিঠিটা থেকে চোখ সরিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,
“এটুকুই?”
“সেটাই তো। মুড়িয়ে ফেলে যাওয়া এসব চিঠি একটাও সম্পূর্ণ নয় ডক্টর। কেন, তাও জানি না।”
ডাক্তার নিজেও একজন মেয়ে। চিঠি দেখে সহজেই বুঝতে পেরেছেন, এ চিঠি কোনো মেয়েলী হাতের অপরিপক্ব চিঠি। একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের এসব বুঝতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না। হাতের লেখাও খুব একটা আহামরি নয়। যেন যত্নের অভাবে পিছিয়ে পড়া কোনো স্টুডেন্টের কাজ।
“আচ্ছা। তা আপনি মেয়েটাকে প্রতিদিনই দেখতে পান?”
“হ্যাঁ।”
“সে আপনার সাথে কথা বলে?”
“না।”
“শুধু ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজ পাচ্ছেন। যা দেখে মনে হচ্ছে সারারাত কেউ চিঠি লেখার চেষ্টা করছে৷ তাই তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম তাই।”
“মেয়েটা কি এখনও আছে আপনার সাথে? মানে এখানে?”
“না না। ও আমার বাড়িতে আছে, একা।”
“মেয়েটার নাম যেন কি বলছেন?”
“নাম তো বলিনি আপনাকে এখনও।”
“কি নাম মেয়েটার?”
“আর্শি।”
আরও পড়ুন গল্প চোখের আলোয় দেখেছিলেম
ডাক্তারের আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ আর ভাবুক চেহারা দেখে তিনি কী ভাবছেন তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিশ্চিতভাবে তিনি ভাবছেন আমার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। হ্যালুসিনেশন কাজ করছে আমার। পুরনো বা অন্য কারও চিঠি এনে তাকে দেখাচ্ছি আর বোকা বানাবার চেষ্টা করছি।
কিন্তু বুঝতে পারছেন না আমার বিষয়টা। বুঝতে চাইছেনও না। ডাক্তারের চিন্তা এখন আমার পরের রোগীকে নিয়ে। আমাদের সাথে কথা বলাটাই তার উপার্জনের উপায়। কিন্তু আমার পরে যে রোগী আসবেন, তিনি আসলে রোগীই নন। কারণ তিনি বেশ মোটাসোটা একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। ডাক্তারের চেম্বারে সাধারণত রোগীরা আসেন ফাইল নিয়ে। তাই তাকে আমার কাছে রোগী মনে হচ্ছে না। ডাক্তার আমার কথার মাঝে বার বার আশেপাশে তাকাচ্ছেন। ডানে, বামে, টেবিলের নিচে। বুঝলাম ডাক্তার আমার কথায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। শ্রোতা শুনতে না চাইলে বলাতেও আর ধার থাকে না। আমিও পাচ্ছি না। তাই বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
গত একযুগ ধরে নিজেকে এমনভাবে রাখি, যেমন প্রেমিক তার মানিব্যাগের চিপায় রাখে প্রেমিকার ছবি। বুকের জমিনে পুঁতে রেখেছি কাকতাড়ুয়া। সেখানে পাখিদের প্রবেশ নিষেধ।
বাসায় এলাম। আর্শি আমার চোখের সামনে দিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ মনে হলো চোখের ভেতর হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে মাথার ভেতর চলে গেছে। মাথার এপাশ থেকে ওপাশ, উফফ… মাথাটা ভীষণ ধরেছে।
আরও পড়ুন গল্প প্রিয়তমার লাল চোখ
মায়ের মৃত্যুর বছর খানেক পর বিয়ে করেছে ছোটো ভাই। এখন বিদেশে স্যাটেলড। বাড়িতে এখন আমি আর আর্শি। আমাদের মাঝে বেশিরভাগ সময় কেবল কয়েক মিটারের দূরত্ব ছাড়া আর কিছুই থাকে না। মাথার ব্যথাটা এমন বাড়ছে, নিজেই নিজের ওপর ভার হারিয়ে ফেলছি। যেন ভারি হয়ে আসছে চোখ, অন্ধকার নামছে পুরো রাজ্য জুড়ে। তবে অনুভব করতে পারছি অবশ হয়ে আসছে শরীর। একটু পরেই ধপাশ করে পড়ব মেঝেতে। ঠিক এমন সময় কে যেন এসে ধরে ফেলল আমায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ হওয়ার আগে আবছাভাবে দেখলাম জামিল ভাই।
দু’দিন আগে বাসার সামনে চায়ের দোকানে পরিচয়। বড়োই অদ্ভুত মানুষ। সময় ফুরিয়ে আসছে কি না কে জানে! চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। শরীরে শক্তি থাকলে জিজ্ঞেস করতাম জামিল ভাইকে…
“সারাজীবন শব্দ জমিয়েও কেউ কেউ কখনই কবি হতে পারে না। কবি না হতে পারার আক্ষেপ নিয়েই বেঁচে থাকে মরার মতো। অথচ কেউ মাত্র তিন শব্দের ম্যাজিকেই হয়ে ওঠেন কবি। কবিতারা তাদেরই হয়। এমন কেন হয় জামিল ভাই?”
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
অন্তর্দাহ