অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৭ম পর্ব)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৭ম পর্ব)
~ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
প্রকাশনা (২য় অংশ):
৪। খগোল পরিচয় (বাংলা একাডেমী, ১৯৬৫ খ্রি.)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার এর অগ্রজ, বিজ্ঞানে মুসলমানের দান-এর লেখক মোহাম্মদ আকবর আলী, তারা সম্বন্ধে কিছু লিখতে এবং তারার গল্প দিয়ে ছোটদের জন্য একখানা বই লিখতে তাঁকে উৎসাহিত করেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি ছোটদের জন্য তারার গল্পের বই লিখবার জন্য পড়াশোনা আরম্ভ করেন। বিভিন্ন দেশে তারা নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। এ সমস্ত গল্প সাধারণত পৌরাণিক কাহিনীর সাথে জড়িত।
গ্রিস, চীন, মিসর, আরব ও ভারত ইত্যাদি দেশ প্রাচীন জোতির্বিদ্যার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। পাশ্চাত্য জগতে যে সমস্ত তারার গল্প প্রচলিত আছে, তার সবগুলোই পূরাণ ইলিয়ডের গল্প নয়। ভারতীয় তারার গল্প ভারতীয় পৌরাণিক গল্পের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ভারতীয় পুরাণ-সাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেখানে এ সম্বন্ধে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন আরবের প্রাগ-ইসলাম জোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে বিশেষ কোন বই পাওয়া পাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে নাসিরুদ্দিন আল-তুসীর কয়েকখানা মূল আরবি গ্রন্থ আছে। কিন্তু তার অধিকাংশই গ্রিক গ্রন্থের অনুবাদ। আলীয়া মাদ্রাসা লাইব্রেরিতে কয়েকখানা আরবি জোতির্বিদ্যার বই আছে। এগুলো সবই ইসলামী যুগের। তারার গল্পের অনুসন্ধান করতে গিয়ে এইভাবে প্রাচীন জ্যোতর্বিদ্যার সাথে কিছুটা পরিচিত হন।
তারার গল্প নিয়ে বই লিখতে গেলে, তাদের পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে জানা দরকার। তবেই এই সমস্ত গল্প ভালভাবে উপভোগ করা যায়। আকাশের তারামণ্ডলী চিনতে গেলে, কেবলমাত্র তারাতেই সন্তুষ্ট থাকা যায় না। মহাকাশের অসীমতা, বিশ্বের বিশালতা, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথ, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোয়েসার ইত্যাদি, অর্থাৎ খগোল সম্বন্ধে কিছু না জানলেও চলে না। তিনি প্রায় এক দশক ধরে এই বই লিখতে আরম্ভ করেন।
৫। তারা পরিচিতি
(বাংলা একাডেমী, ১৯৬৭ খ্রি.; অতঃপর বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন কর্তৃক দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৯৪ খ্রি., তৃতীয় প্রকাশ এপ্রিল ২০০৫ খ্রি., চতুর্থ প্রকাশ এপ্রিল ২০০৬ খ্রি., পঞ্চম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৭ খ্রি. এবং ষষ্ঠ প্রকাশ মার্চ ২০০৯ খ্রি.)
আকাশের রহস্য মানুষের মনকে চিরকাল আকৃষ্ট করে এসেছে। আকাশ কি? এর কি কোন সীমা রেখা আছে? এর নীল রং- এর উৎস কি? অতি আদিম কাল থেকেই মানুষের মন যে তারায় ভরা আকাশের শোভায় আকৃষ্ট হয়েছে, তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়, গুহা-মানুষের গুহার ভেতরে আকাশের তারার ছবিতে। প্রত্যেকটি প্রাচীন সভ্য দেশ আকাশের তারাদের নিয়ে আলোচনা করেছে, তারার সাথে তারা মিশিয়ে নানা রকমের ছবি কল্পনা করেছে, সেই সমস্ত ছবি দিয়ে কল্প কাহিনী তৈরি করেছে। এই সমস্ত তারার ছবির অনেকগুলোই আধুনিক জোতির্বিদগণও গ্রহণ করেছেন।
আকাশে সূর্যকে বৃত্ত পথে ঘুরতে দেখা যায়। সূর্যের এই আপাত ভ্রমণ বৃত্ত পথকে প্রত্যেকটি আদিম সভ্য জাতি বারো ভাগে ভাগ করে। কোন দেশই বারোর বেশি বা কম ভাগে ভাগ করে নাই। কোথায় গ্রিস, আর কোথায় ভারতবর্ষ আর কোথায়ই বা সুদূর চীন। এই সমস্ত দেশের মধ্যে যখন যোগাযোগের কোন সম্ভাবনাই ছিল না, তখন এমন অদ্ভুত মিল খুব আশ্চর্য বলে মনে হয়। আশ্চর্যের বিষয় কেবলমাত্র চীন ছাড়া, গ্রিস, মিশর, ক্যালডিয়া, আরব, ভারতবর্ষ প্রভৃতি প্রত্যেকটি দেশে এই অংশগুলির নাম হুবহু এক এবং তাদের ছবিও প্রায় একইরূপ। যেমন সিংহ রাশি (বাংলা নাম) আরবীতে আসাদ, পাশ্চাত্য নাম লিও এবং রাশির ছবি সব ক্ষেত্রেই সিংহ। এইভাবে তিনি প্রচুর আশ্চর্যজনক কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক মিল দেখিয়েছেন।
তারা চেনা দরকার কি? কোটি টাকার প্রশ্ন। সাধারণ আমজনতার জন্য এটি নেহাত শখের ব্যাপার। কিন্তু অভিযাত্রীর যুগে, মহাসমুদ্রে যেখানে দিকনির্দেশনার কিছুই ছিল না, সেখানে একমাত্র তারার অবস্থানের উপর নির্ভর করে দিক নির্ণয় করা হত। ম্যাগেলান, কলম্বাস ইত্যাদি অভিযাত্রীগণ তারা দেখে, দিক নির্ণয় করে মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশ, মহাদেশ আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। প্রচীন কালে আরব, ইউরোপীয় বণিকগণ তারা দেখে, দিক নির্ণয় করে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশ বিদেশে বাণিজ্য করতেন।
আরও পড়ুন সরদার জয়েন উদদীন এর সাহিত্য মূল্যায়ন
তারা চিনতে মণ্ডল চেনা দরকার। আর মণ্ডলের প্রচলিত ছবির কাঠামো থেকেই মণ্ডলের অবস্থানের একটা স্থুল ধারণা করা যেতে পারে। কোন তারাটি ছবির কোন অংশে অবস্থিত, এ বিষয়টি জানতে পারলে মণ্ডল ও তারা চেনা সহজ হয়ে পড়ে।
তিনি তারা পরিচয় বইটিতে তারার শ্রেণি বিভাগ, তারার অবস্থানের গাণিতিক নির্দেশ, তারা চেনার উপায়, মাসওয়ারি মণ্ডলসমূহের উপর আলোচনা, মণ্ডলসমূহের ভারতীয়, আরবি ও পাশ্চাত্য নাম ইত্যাদি নিয়ে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন।
তিনি জোতির্বিজ্ঞানের উপর যে সমস্ত বই লিখেছিলেন, তার ভেতর সব চাইতে উল্লেখযোগ্য হল তারা পরিচিতি। এই বইটি উভয় বাংলায় খুবই সমাদৃত হয়েছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকাতে (২৪শে চৈত্র, ১৩৭৯) বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন “মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে বিজ্ঞানের রাজ্যে এমন একখানা পুস্তক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন বই উভয় বাংলায় পূর্বে বেরোয়নি, আগামী শত বৎসরের ভিতরে বেরুবে কিনা সন্দেহ। পণ্ডিত আব্দুল জব্বার রচিত এই তারা পরিচিতি গ্রন্থখানিকে ‘শতাব্দীর গ্রন্থ’ বলে তর্কাতীত দার্ঢ্যসহ পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়।”
৬। জগত ও মহাজগত (অনুবাদ) (বুক ভিলা, ১৯৬৮ খ্রি.)
৭। চাঁদের দেশে এ্যাপোলো (মওলা ব্রাদার্স, ১৯৬৯ খ্রি.)
৮। জ্ঞান ও বিস্ময় (অনুবাদ) (বুক ভিলা, ১৯৭০ খ্রি.)
৯। প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা
(প্রথম প্রকাশ, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৬ খ্রি., দ্বিতীয় প্রকাশ, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন, ২০০০ খ্রি.)
জোতির্বিদ্যার প্রাচীন কাহিনী শুধুমাত্র মৃতই নয়, একেবারে ধূলীভূত আবর্জনা। সেই আবর্জনা বিশ্লেষণ করে মরা দেহের অনুসন্ধান করার কোন সার্থকতা আছে বলে আমি নিজেই মনে করি না। তবু কেন এই আবর্জনা ঘাঁটবার দিকে মন গেল, তার একটা কৈফিয়ত দাঁড় করানো যেতে পারে।
প্রাচীনকালে গ্রামে কুলীন-প্রথা অত্যন্ত প্রকট ছিল। এ কুলীন-প্রথা শুধু সামাজিক নয়, একবারে আন্তর্জাতিক। ভারতীয় সভ্যতা অনেক প্রাচীন, ভারতবর্ষ যখন সভ্যতার উচ্চশিখরে সমাসীন, ইউরোপের বর্তমান সভ্য দেশসমূহের পূর্বপুরুষগণ তখন জঙ্গলবাসী, ইত্যাকার নানা কাহিনী প্রচলিত ছিল এবং সে জন্য আমাদের বেশ গর্ব বোধ ছিল। জ্যোতির্বিদ্যা পড়তে আরম্ভ করলেই, এই প্রাচীনতা আর বনেদিয়ানার দাবির প্রতিযোগিতা চোখে পড়বে। তাই তিনি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে। পড়াশোনা আরম্ভ করেন।
অনেক লোক একত্রে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা, অর্থাৎ বড় গ্রাম বা শহর প্রতিষ্ঠাই যদি সভ্যতার প্রথম স্তর বলে ধরে নেওয়া যায়, তা হলে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা নিঃসন্দেহে প্রাচীনতম। খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ অব্দে প্যালেস্টাইনের দক্ষিণে মরু সাগরের তীরে মানুষ প্রথম বাড়িঘর তৈরি করে একত্রে বসবাস শুরু করে। বেবিলনীয় সভ্যতার বিকাশলাভ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩,৫০০ অব্দে। মিসরে কৃষিকার্য আরম্ভ হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪,৫০০ অব্দে এবং শহর গড়ে উঠে ৩,৫০০ অব্দে। এর কাছাকাছি সময়ে মিসরে আনেক বড় বড় পিরামিড নির্মিত হয়, অর্থাৎ মিসরের জ্ঞান, বিজ্ঞান তথা মিসরের সভ্যতাই প্রাচীনতম। তিনি, সেজন্য এই গ্রন্থে প্রথমে মিসরীয় জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন ।
আরও পড়ুন হাদীসের গল্পগুচ্ছ বই রিভিউ
মুসলিম জ্যোতির্বিদগণের অসংখ্য পর্যবেক্ষণ-তালিকা পরবর্তী যুগের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করে। এদিক দিয়ে মুসলিম যুগের জ্যোতির্বিদ্যাকে গ্রিক ও আধুনিক জোতির্বিদ্যার সেতু বলা যেতে পারে। এ জন্যই গ্রিক জ্যোতির্বিদ্যার পরেই মুসলিম যুগের জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা করেছেন।
খ্রিস্টপূর্ব মাঞ্চুরিয়ায় যে শত শত, এমনকি হাজার হাজার গ্রাম ছিল এবং এই সমস্ত গ্রামে চাষাবাদ হতো। কাঠের জিনিসপত্র ও পরিধেয় বস্ত্রাদি তৈরি করা হতো, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে ইয়ংশাও জাতি কর্তৃক নির্মিত ও নানাভাবে চিত্রিত মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। সুতরাং মনে করা যেতে পারে, তার পূর্বেই চীনা সভ্যতা গড়ে উঠে। চীনা জোতির্বিদ্যা অন্যান্য দেশের জোতির্বিদ্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে বিকাশ লাভ করেছে। চীনা তারাচিত্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের তারাচিত্রের কোন সম্বন্ধ নাই। এতে সহজেই বোঝা যায় যে, চীনের জোতির্বিদ্যা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছে।
ভারতীয় জোতির্বিদ্যা সম্পূর্ণরূপে গ্রিক জোতির্বিদ্যা থেকে গৃহীত। শীঘ্রবৃত্ত, মন্দবৃত্ত, অর্থাৎ সেই গ্রিক এপিসাইকেল ও ডেফোরেন্টের সাহায্যই ভারতীয় জোতির্বিদ্যার গণনা কার্য করা হতো। গ্রিক জ্যামিতি এখানে প্রকটভাবে কার্যকর।
মুসলিম যুগের পরেই তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ভারতীয় ও চীনা জোতির্বিদ্যা নিয়ে।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৭ম পর্ব)