হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৩য় পর্ব)
হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৩য় পর্ব)
বিমল কুণ্ডু
দিনের আলো ফুটে উঠেছে। রহিম সেখ নবীন হুজুরের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। করুণ কণ্ঠে বলে, হুজুর নাস্তার কোন ব্যবস্থা নাই। গুনাগার বান্দারে মাফ কইরা দ্যান। এমন সময় মতি এক খুঁড়ি দুধ হুজুরের সামনে এনে রাখে। রহিমের মুখ উজ্জ্বল হয়। অতি ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আল্লাহ মান রাখছে। হুজুর নেকবান্দা, দুধড়া খাইয়া লন।
হুজুর শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, এই গ্রামে খুব অভাব, তাই না?
রহিম সেখ উত্তর দেয়- খুউব।
হঠাৎ হুজুর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, চলেন, আপনাদের গ্রামটা একটু দেখে আসি।
দুধড়া খাইয়া লন হুজুর। রহিম অনুরোধ জানায়।
হুজুর জবাব দেন-না, এত অভুক্ত মানুষকে রেখে দুধ খেলে আল্লাহর কাছে গুনাগার হব।
ঘর থেকে হুজুর বাইরে পা বাড়ান। রহিম সেখ তাকে অনুসরণ করে। দুর্বল শরীরে গ্রামের সবটা ঘোরা সম্ভব হয় না। দু-একটি পাড়া ঘুরে সবার খোঁজ-খবর নেন হুজুর।
জানতে পারেন, গ্রামের সবাই অশিক্ষিত, হতদরিদ্র। গ্রামে কোন স্কুল-মাদ্রাসা, চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। নেই কোন টিউবওয়েল। ঘরে ফিরে চুপ করে শুয়ে কি যেন ভাবতে থাকেন। অনেকক্ষণ পর উঠে বসেন। উচ্চ স্বরে ডাক দেন-সেখ সাহেব।
রহিম উত্তর দেয়-কন হুজুর।
বৈকাল বেলায় গ্রামের সবাই যেন আপনার বাড়ির সামনে জমায়েত হয়। যতদূর পারেন খবর দেন। আমি সবার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
রহিম সেখ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো, হুজুর কি আমাগো ফ্যালাইয়া চইলা যাইবেন? নিম্নস্বরে হুজুর বললেন, আল্লাহ আমাকে নতুন জীবন দান করছে। আজ আমি রোজা রাখছি। আপনার কথার উত্তর জমায়েতে দিব।
আরও পড়ুন গল্প মামৃত্যু
চর এলাকায় জমি নিয়ে প্রায়ই কাজিয়া হয়। সে সময় ঢোল বাজানোর নিয়ম আছে। রহিম বুদ্ধি করে টিন বাজিয়ে জমায়েতের কথা জানিয়ে দিল। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দলে দলে নারী-পুরুষ এসে জড়ো হয় রহিম সেখের বাড়ির সামনে। প্রায় হাজার খানেক মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে হুজুরের কথা শোনার জন্য। আছরের নামায শেষে হুজুর এসে দাঁড়ান সমবেত জনতার সামনে। শান্তভাবে সালাম জানান সবাইকে। সুযোগ বুঝে মাতুব্বর আজিজ সরদার এগিয়ে আসে, হুজুর পেরথমে আমারে কিছু কইতে দ্যান।
সরদার নিজেই শুরু করে, ভাইসব, চরের মদ্যি আমাগো বাপদাদা বসতি করছিল। আমরা মূর্খ মানুষ। পেট ভইরা খাওন পাইনা। আগে নাওডুবি অনেক মানুষকে আমরা মারছি। তাদের জামা-কাপড়, ট্যাহা লুট করছি। আল্লার রহমে হুজুররে কেউ মারে নাই। সে আল্লার নেকবান্দা। তার বয়ান আপনারা শোনেন। গুনাগারী সব মাফ হইয়া যাইবো। হুজুর আপনে এহন কন।
সুদর্শন যুবক হুজুর মিতভাষ্যে শুরু করেন।
আমাকে যে দুইজন মরণের হাত থেকে উদ্ধার করে আনছেন আল্লাহ মাবুদের কাছে আমি তাদের জন্য দোয়া করি। আপনারা এই গ্রামবাসী সবাই আমার এই নতুন জীবন লাভের উছিলা। তাই আপনাদের খেদমতে আমার এই ক্ষুদ্র জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ভাই ও বহিনগণ,
আমি আপনাদের চাইতেও নিঃসম্বল। সে কথাই সবাইকে জানাতে চাই। আমার নাম হাফেজ আজাহার আলী। বাপ-মাকে কোনদিন দেখি নাই। এতিমখানায় মানুষ হয়েছি। সেখান থেকে আল্লাহর কুরআনে হাফেজ। একটা মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করি আর বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ছিপারা, কুরআন তামিল দেই। মানকের চরে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। তারপর নৌকাডুবি। পরের ঘটনা আপনারা জানেন। আল্লাহর কেতাবে পড়ছি মানুষের কল্যাণে কাজ করা সবচেয়ে বড় ইবাদত। আপনাদের দুঃখ কষ্ট দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনাদের দুঃখের অংশীদার হয়ে এখানেই থেকে যাব। মানুষের অভাব আর দুঃখ কষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ অশিক্ষা।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ যেভাবে আপনারা ঝড়ের মোকাবিলা করছেন, ঠিক সেভাবেই আগামীকাল আর দুইটা ঘর তুলে দিবেন। তার একটা হবে মসজিদ অন্যটায় স্কুল। সেই স্কুলে আপনাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। আমি নিজেই তাদের পড়াব। মেয়েরাও আমার কাছে ছিপারা শিখবে। হিন্দু ভাইরাও তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন। শরীর একটু ভাল হলে গঞ্জে গিয়ে আমি বই-পত্তর নিয়ে আসবো। ইনশাআল্লাহ্ শিক্ষার আলোয় একদিন এই গ্রামের সব অভাব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
হুজুর একটু থামলেন। জনতার পক্ষ হতে মাতুব্বর চিৎকার করে উঠলো-হুজুর আপনে আগাইয়া যান-আমরা আপনার লগে আছি। কালই মসজিদ আর স্কুল ঘর উঠবো।
হুজুর মাথাটা তুলে এবার একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, আর একটা কথা বলতে চাই। আপনাদের গ্রামে বাস করার মতো আমার একটু জায়গা দিতে হবে। তার সঙ্গে আর একটা জিনিস চাই। সবাই একযোগে বলে উঠলো, হুজুর আপনে আমাগো ভালা চান, আপনারে আমরা সব দিয়া দিমু।
এবার হুজুরের মুখটা একটু রক্তিম হলো, আনত ভঙ্গিতে বললেন, কি কথা বলবো। আপনারা জানেন কদম আলী আর লস্কর মাঝি আমাকে নদী হতে তুলে আনছে। আসলে আমার নতুন জীবন দিছে রহিম সেখের কন্যা মতি বিবি। তাকে আমার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হেফাজত রাখছিল। আমি মতি বিবিকে শাদী করিতে চাই। দশজনের সামনে কন্যার বাপ তার মত জানাক।
রহিম সেখ আনন্দে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, দশজন হুনেন, আমার কোন অমত নাই।
হুরমতি একপাশে দাঁড়িয়েছিল। মাথায় ঘোমটা টেনে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেল। তার বুকে তখন যমুনার ঢেউ উঠেছে। আকাশের চাঁদ এভাবে তাকে ধরা দেবে তাকি কখনো ভেবেছিল সে?
এভাবেই শুরু সানন্দবাড়ী গ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ।
এখন প্রতিদিন পাঁচবার মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। হতদরিদ্র মানুষগুলো নামাযে শামিল হয়। পরম করুণাময়ের রহমতের আশায় হাত তুলে মোনাজাত করে। হোগলা পাতায় গড়া স্কুল হতে শিশুদের কলকাকলী ভেসে আসে। সন্ধ্যায় মেয়েরা সুর করে ছিপারা পড়ে।
আরও পড়ুন গল্প অশরীরী আত্মা
ইতোমধ্যে গ্রামের লোকেরা মিলে সানন্দবাড়ীর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দিয়েছে চর হাফেজিয়া। হুজুরের প্রচেষ্টায় দেওয়ানগঞ্জের সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর। জেলেরা গঞ্জের আড়তে মাছ পাঠানোর সুযোগ পেয়েছে। চাষীরা চরের জমিতে বাঁধ দিয়ে ফসল রুয়ে বেশি বেশি শস্য পাচ্ছে। হুরমতির এখন সুখের সংসার। তার গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে একটি ছেলে। নাম রাখা হয়েছে রহমত আলী। কিন্তু সুখ একটু ম্লান হয়ে গেল বছরখানেক পরে। যখন দেখা গেল যে শিশুটি হাঁটতে পারছে না। হাফেজ সাহেব অনেক কোশেশ করে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে একটু হাঁটতে শেখালেন। কিন্তু তার একটা পা খোঁড়াই থেকে গেল। একেবারে জন্ম খোড়া। মতির প্রশ্ন থেকে যায়, এত নেকবান্দার ছেলে খোঁড়া হলো কেন? হুজুর সান্ত্বনা দেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। সময় মতো ছেলেকে তিনি পড়ালেখায় তালিম দিতে থাকেন।
জাগতিক সুখ কখনো স্থায়ী হয় না। চর হাফেজিয়ার মানুষের সামান্য প্রাপ্তিও হঠাৎ একদিন বিলীন হওয়ার উপক্রম হলো। ১৯৬০ সালের ভয়াবহ বন্যায় ডুবে গেল সমস্ত গ্রাম। ঘর-বাড়ি, গরু-বাছুরসহ বহু মানুষকে চিরতরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সর্বনাশা বন্যার পানি। সবচেয়ে মর্মান্তিক খবর হলো, একদিন যে মানুষটি যমুনায় ডুবে গিয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল এই গ্রামে এসে, আবার সেই গ্রাম থেকেই সে তার প্রাণদায়ী প্রিয়তমা স্ত্রীসহ বানের জলে হারিয়ে গেল। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল তাদের পঙ্গু সন্তান রহমত আলী।
আরও পড়ুন গল্পটির-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৩য় পর্ব)