শরতের-মেঘ-১ম-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

শরতের মেঘ (১ম পর্ব)

শরতের মেঘ (১ম পর্ব)
শাহানাজ মিজান

দু’চোখের পাতা এমনি এমনিই বন্ধ করে ছিলাম কিছুক্ষণ। ভাবলাম, ঘুম আসবে কিন্তু ওরাও পালিয়েছে। হয়তো চিরদিনের জন্য আসবে বলে ছুটি নিয়েছে আজ। জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকালাম, ঝিরিঝিরি বাতাসে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল একবার। সীমাহীন আকাশের এক চিলতে জায়গা জুড়ে বসে থাকা চাঁদটাকে বড়ো খুশি খুশি মনে হচ্ছে, সে ঝিকিমিকি জোৎস্নার ফুল ফুটিয়ে তারাদের নিয়ে খুশিতে মেতে উঠেছে। শরতের থোকা থোকা সাদা মেঘমালা, চাঁদের খুশিকে হিংসে করছে বোধহয়। সেও মুচকি মুচকি হেসে, নীলাভ পাখা মেলে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে দূর-বহুদূর। চোখের সীমানায় যতদূর দেখা যায়, আমি ততদূর চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু। কি যেন ভাবলাম আনমনে, ভুলে যাই বার বার।
জোৎস্নার সিড়ি বেয়ে চোখদুটো নেমে এল মাটির পৃথিবীতে। এখানেও যেন চারদিকে সৌন্দর্যের অবাধ আবেশ ছড়ানো। চাঁদের খুশিকে বাড়িয়ে তুলেছে এক ঝাঁক জোনাকি, ওরাও জোৎস্নার আলোয় নিজেদেরকে পৃথিবীর তারা ভাবছে হয়তো। আলো-আধারিতে কি সুন্দর করে লুকোচুরি খেলছে!

পৃথিবীর যে এত রূপ, এত বৈচিত্র, এত সৌন্দর্য; মনে হচ্ছে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। যেদিন থেকে শুনেছি আমি আর কিছুদিন মাত্র এই পৃথিবীর অতিথি, সেদিন থেকে পৃথিবীটাকে যেন নতুন করে দেখছি। যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই সৌন্দর্যের হাতছানি। মনে হয় যেন এই সৌন্দর্যমণ্ডিত পৃথিবী আমাকে ডেকে ডেকে বলছে, তুমি যেও না। থেকে যাও আরও কিছুদিন, তোমার যে অনেক কিছু পাওয়ার আছে।
কিন্তু কি করে বলব আমি, তোমার কাছে কিছু পাওয়ার আগেই যে আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেল।
জীবনের পায়ে বেধেছি মরণ নুপুর, হৃদয়টা একাই ব্যথায় পাথর হয়ে গেছে আজ। অপেক্ষার প্রহর গুনছি শেষ বিদায়ের। এ অপেক্ষা যে বড়োই যন্ত্রণাদায়ক।
আর তো মাত্র কটা দিন বাকি আছে। একে একে সব আশা হয়ে যাবে ভুল, স্বপ্নগুলোও ভেঙে যাবে, সব আপনজনেরা পর হয়ে যাবে, সময়ের পরিক্রমায় ভুলে যাবে সবাই সবকিছুই ।
ভালোই হলো, আগে হোক পরে হোক, সবাইকে যে মৃত্যু নামক এক পেয়ালা অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। আজ আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি, এক অমোঘ সত্যবানের নাম হলো মৃত্যু। মৃত্যু আছে বলেই তো জীবনকে এত সুন্দর
মনে হয়।

কত রঙে রঙিন চারদিক, কত রঙের মানুষের সাথে কত যে রঙিন পরিচয়। অথচ মৃত্যুর কত শক্তি দেখ, সমস্ত রঙিন পরিচয় বিলীন হয়ে যায় তার কাছে।
সব জানি, সব বুঝি, তবু মন যে কেন মানে না। কেন বার বার তোমার কথা মনে পড়ছে! কেন মনে হচ্ছে, যদি একবার তোমার বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম, বলতে পারতাম সব না বলা কথাগুলো—
অনল, ছোট্ট একটি জীবন নিয়ে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আর এই জীবনে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। আমি তোমাকে নিয়ে কান্না ভেজা কষ্টের কবিতা লিখতে চাইনি, একটা সুখের উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, অথচ দেখ-আমার জীবনের গল্পটাই কত ছোটো হয়ে গেল। অনল, আমি বাঁচতে চাই, শুধু তোমার জন্য বাঁচতে চাই। আমি খুব ভালোবাসি তোমাকে, বড়ো বেশিই ভালোবাসি। এক জনমে ভালোবাসার স্বাধ কারও কি কোনোদিনও পূর্ণ হয়, বলো। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না অনল…আমাকে জোর করে ধরে রাখ তোমার কাছে।

পেছন থেকে কেউ আমাকে ধরে আছে। চোখ মেলে দেখলাম, বউদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
— শুভ্রা, তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে খুব…?
— (জোরে নিশ্বাস ছেড়ে) নাহ্ …বউদি।
— তাহলে এত জোরে কাঁদলে যে!
— ওহ্, কেদেঁছিলাম বুঝি? বউদি…অনলের কথা খুব মনে পড়ছিল আজ। তাই ঐ আকাশের দিকে তাকিয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম। তুমি জানো বউদি…বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে, নাচতে গিয়ে ওর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমি নাচতাম আর ও নজরুলগীতি গাইত। কি সুন্দর করে যে ও গান গাইত, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ওকে প্রথম দেখেই নিজের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করলাম। নিজেকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আজ থেকে আমি আর একা নই, ওকে আমি নিজেই নিজের করে নিয়েছি।
তারপর একে অপরের ভালো লাগার কথা, ভালোবাসার কথা, দুজন-দুজনের কাছে কতবার বলেছি…।
নদীর পাড়ে পাশাপাশি বসে, জলের মধ্যে ঢিল ছুড়ে, ঢেউ গুনেছি বহুবার। কত স্বপ্ন বোনা ছিল, কত আশা। জানো, আমরা দুজনে শরতের এক বিকেলে কাশফুল দেখতে গিয়েছিলাম, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। ও বলেছিল, আমি নাকি দেখতে শরতের নীল আকাশে জমে থাকা থোকা থোকা সাদা মেঘের মতোই সুন্দর! আমি বলেছিলাম, তাহলে আমিও একদিন ঐ মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যাব। ও সেদিন আমার মুখে হাত দিয়ে বলেছিল, এমন কথা যেন আর কোনোদিন না বলি। অথচ আজ ভাগ্যের পরিহাস দেখ, সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল।
— আমি তোমাদের সব কথা জানি শুভ্রা, এখন একটু চুপ করো, একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো…ভালো লাগবে।
— একটু নয় বউদি, সারাজীবনের জন্য তো ঘুমোবোই, তোমার সাথে একটু কথা বলতে ভালো লাগছে। বাবা-মা আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে বড়ো ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই না বউদি? ঘুমিয়েছে না?
— (ফুপিয়ে কাঁদছে) হুম, তুমি এমন করে কথা বলো না শুভ্রা। তুমি চাও তো, অনল কে ফোন দিই…
— না না বউদি, এটা করো না। এই তো সন্ধ্যায় ওদের বিয়ে হলো, এখনই কিছু বলো না। পরে বলো, যখন আমি থাকব না…।
— আর কত দিন লুকিয়ে রাখব বলো। একদিন তো ওরা সবটা জানতেই পারবে। তাছাড়া যে কাজের জন্য এই সত্যটা লুকিয়ে রাখা, সেটা তো হয়েই গেছে। যাকে এত ভালোবাসলে, তাকে কি করে অন্যের হতে দিলে। নিজেই নিজেকে অনলের চোখে খারাপ প্রমাণ করলে, আবার আমাকে দিয়েও মিথ্যে বলতে বাধ্য করলে।
— এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বউদি। তুমি তো জানো, অনল আমাকে কত ভালোবাসে। আমার শারীরিক অবস্থার কথা জানলে, ও কোনোদিন আমাকে একা একা কষ্ট পেতে দিত না। ওর চোখের সামনে আমার মৃত্যু হলে, ও কোনোদিনও অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী রূপে গ্রহণ করত না। ওর সুন্দর জীবন, ওর ভবিষ্যৎ, সব নষ্ট হয়ে যেত। ভাগ্যিস সুদীপ দাকে ও চেনে না।
তুমি, সুদীপ দা, দাদা সবাই মিলে যদি এসব কথা বলে ওর বাবা মাকে উসকে না দিতে, তাহলে উনারা এত তারাতারি অনলকে বিয়ে দিতেন না। তাছাড়া, আমি জানি শিখা খুবই ভালো মেয়ে। শিখা আর অনল খুব ভালো বন্ধু, ও অনলকে খুব ভালোবাসে। ওরা খুব সুখী হবে দেখ তোমরা।
আমি তো এটাই চেয়েছিলাম বউদি। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবেসে আগলে রেখে সুখী করার মতো সুখ পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই। অথচ দেখ, সেই সৌভাগ্য আমার হলো না। এত ভালোবাসি বলেই তো তাকে অন্যের হাতে তুলে দিলাম, যে তাকে ভালোবেসে ভালো রাখবে।
(ফোন বের করে) দেখ বউদি, আমার বন্ধু উৎসব, ওর বিয়েতে গেছে, ছবি পাঠিয়েছে। অনলকে বর বেশে কি সুন্দর দেখতে লাগছে! …উহ্, বুকের ভেতরটা কেমন যেন দুমরে-মুচড়ে যাচ্ছে, বউদি। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম, তবে কেন এত কষ্ট হচ্ছে।
— (মাথায় হাত বুলিয়ে) একটু শান্ত হও শুভ্রা, ডাক্তার কাকাকে ফোন দিব…।

শুভ্রা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বউদি চিৎকার করে সবাইকে ডাকল।

অনলের বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় বউভাত অনুষ্ঠান। এখন ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হবে। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল অনল। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, তার ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শিখা সবটা বুঝতে পারছে, তবু বিয়ের নিয়ম বলে কথা, সব তো মানতেই হবে।
ড্রয়িং রুম ভর্তি মেহমান, অনলের মা-মাসি।
ভাত কাপড়ের বড়ো বড়ো থালা নিয়ে প্রস্তুত। শিখাকেও দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। অনল থালাগুলো হাতে নিতে যাবে, ঠিক তখনই ঝড়ের বেগে দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়াল সুদীপ।
সুদীপকে দেখতে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। সবাই রাগী চোখে সুদীপের দিকে তাকাল। সুদীপ বুঝতে পারল সবই, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ সে বড়োই অসহায়। অনলের হাত দুটো চেপে ধরে বিনয়ের সাথে বলল,
— অনল, তারাতারি আমার সাথে চলো ভাই। হাসপাতালে যেতে হবে…
প্রশ্নাতুর চোখে সবাই চেয়ে আছে।
— হা-স-পাতালে! কেন?
— চলো না প্লিজ, যেতে যেতে বলছি সব।
অনলের মা-বাবা বাধ সাধলেন। এখন বড়ো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। সুদীপ সবার কাছে হাত জোর করে অনলের পায়ের কাছে বসে পড়ল।
— অনল, আজ যদি তুমি না যাও, তাহলে হয়তো আর কোনোদিন শুভ্রার সাথে তোমার দেখা হবে না…।
শুভ্রার কথা শুনে সবাই আরো রেগে গেল। অনল মুখ ঘুরিয়ে রইল। অনলের মাসি ব্যঙ্গ করে বলল,
— শুভ্রা তোমার স্ত্রী, সে হাসপাতালে, তো অনল সেখানে গিয়ে কি করবে! তোমরা সবাই বলেছিলে অনল খারাপ ছেলে, চরিত্রহীনের অপবাদ দিয়ে তাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছ। বলেছ, তাকে নাকি আমরা কোথাও বিয়ে দিতে পারব না ইত্যাদি ইত্যাদি…। এখন নিজ চোখে দেখলে তো! তুমি এখন আসতে পারো বাপু, আমাদের অনেক কাজ পরে আছে, তোমার নাটক দেখার সময় আমাদের নেই।
— ঠিকই বলেছেন মাসীমা, নাটক করেছি আমরা। তবে আপনাদের সাথে যতটুকু করেছি, তার চেয়েও বেশি করেছি নিজেরাই নিজেদের সাথে।

আরও শরতের মেঘ-
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

শরতের মেঘ (১ম পর্ব) 

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!