রৌদ্রডোবা-চাঁদ-শেষ-পর্ব
আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব)

রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব)

আবু জাফর খান

 

দুজনই চুপচাপ বসে আছে। হয়তো একযুগ আগের কোনো উচ্ছ্বল মুহূর্তে দুজনই বিভোর। ট্রেন হুইসল বাজিয়েছে। লোকজন দ্রুতপায়ে ছুটছে ট্রেনের দিকে। বিদিতা উঠে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র কী ভাবনায় যেন মগ্ন। তাকিয়ে আছে দূরের অন্ধকারের দিকে। বোধ হয় হুইসলের শব্দ শোনেনি রুদ্র।বিদিতা চেঁচিয়ে বলল,
“অ্যাই রুদ্র, কী রে, চল ওঠ, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে যে!”
অন্যমনস্ক রুদ্র মুখ ঘুরিয়ে বিদিতার দিকে তাকাল। চোখ দুটি কী ভীষণ নির্জন! বিদিতার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল।
ঘোর-লাগা মানুষের মতো রুদ্র ফিসফিস করে বললো,
“যদি আর না যাই? তবে কেমন হয়?”
“মানে?”
“এই স্টেশনেই যদি থেকে যাই, আমি আর তুই… অনন্তকাল?”
“বলে কী পাগলটা!”
বিদিতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মানুষটির দিকে। তার বুকের ভেতর রেল-ইঞ্জিনের মতো তীব্র ধকধক শব্দ। গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে তার ফিনফিনে ভাঙা কাচের মন। ওদিকে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে। বিহ্বল বিদিতা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে। রুদ্রর মায়ের উৎকণ্ঠিত মুখ ট্রেনের জানালায়। অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বিদিতার পা যেন গেঁথে গেছে প্লাটফর্মে। রুদ্র যে কখন তাকে হ্যাঁচকা টানে উড়িয়ে নিয়ে ট্রেনে তুলেছে তা সে নিজেও জানে না।

আরও পড়ুন গল্প এখানে স্নিগ্ধ সকাল

বিদিতা বসে ছিল চোখ বন্ধ করে। অনেকেই ভিড় করে আছে চারদিকে।
রুদ্রর মা বললেন,
“হঠাৎ কী হয়েছিল তোমার? শরীর খারাপ করেছিল? রুদ্র তোমায় টেনে না তুললে কী হতো বলো তো? আমি তো চেইন টানতে যাচ্ছিলাম। আর একটু স্পিড বাড়লে তো তোমরা ট্রেনে উঠতেই পারতে না!”
লাজুক মুখে মলিন হেসে বিদিতা বলল,
“হ্যাঁ, মানে… মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল।”
রুদ্রর মুখে ঈষৎ ফিকে হাসি।
“তুই যতই খুকি সেজে থাকিস, প্রমাণ হয়ে গেল যে তোরও বয়স বাড়ছে রে বিদি। এখন থেকে প্রেশার চেক করাবি নিয়ম করে।”
বিদিতা কপট রাগে রুদ্রর দিকে তাকাল।
রাত নেমেছে। ট্রেন ভাটিয়ারি পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ফৌজদারহাট স্টেশনে।
রুদ্র বলল,
“এখানে ট্রেন অনেকটা সময় ওয়েট করবে। চল একটু হেঁটে আসি।”
গমগম করছে ফৌজদারহাট স্টেশন চত্বর। মাইক্রোফোনে বাজছে ট্রেন সংক্রান্ত নানান ঘোষণা। কথা বলতে বলতে চলাফেরা করছে ব্যস্ত মানুষজন। হকার, কুলি, টিকেট চেকার, রেল পুলিশ আর অগুনতি মানুষে ছেয়ে আছে প্লাটফর্ম। ওরা হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। এখানে মানুষের ভিড় তেমন নেই। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। বহুকাল পর আজ আবার।

আরও পড়ুন গল্প মৃত বৃক্ষ

বিদিতার মন ভার হয়ে আছে। বেশ খানিকটা আনমনাও। কেন যে এমন মেঘলা হয় মন! সম্বিত ফিরল রুদ্রর কথায়।
“বিদি, আমি একটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির রিজনাল ম্যানেজারের দায়িত্বে আছি। তিন পার্বত্য জেলায় আমার কাজ। তবে বেইস বান্দরবানে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। কোনো পিছুটান নেই। মাকে নিয়ে থাকি। মায়ের বয়স হয়েছে। উনি চলে গেলে একেবারে একা হয়ে যাব। মন খারাপ হলে নীলগিরিতে গিয়ে বসি। ভালো লাগে।”

নীলগিরির কথায় চমকালো বিদিতা। রুদ্র কথা বলছিল আর বিদিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এক সময়ের অতি প্রিয় মানুষটি কেমন আছে সেই চোরা কৌতূহল কি শুধু মেয়েদেরই থাকে? এতক্ষণ একসঙ্গে আছে, অথচ ওর বিদি কেমন আছে একবারও তো জানতে চাইল না রুদ্র! ওর বিদি সম্বন্ধে তো একটিও প্রশ্ন করল না সে… তবে?
বিদি একটুও ভালো নেই রুদ্র!!

কেমন এক কষ্ট, একটি কান্নার প্রপাত ঘূর্ণাবর্তের মতো অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে বিদিতার মনের ভেতর। কোনো লাঞ্ছনা বা বঞ্চনা নয়, কোনো নিচুতা নয়, তবুও বিদিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে অপূর্ণতা আর তুচ্ছতার বোধ। সুগত ভীষণ ভালোমানুষ। বিদিতাকে ভালোও বাসে তার মতো করে। কিন্তু সুগতর মধ্যে সেই প্রাণ কোথায়! চেষ্টা করেও কি সে রুদ্র হতে পারবে কোনো কালেও! সুগত স্বামী। শুরু থেকেই পুরোদস্তুর স্বামী। প্রেমিক কখনো নয়। সুগতর সঙ্গে কাটানো একটিও তরল কিংবা মাতাল মুহূর্তের কথা চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না বিদিতা।

আরও পড়ুন গল্প জোছনা মাখা আলো

কণ্ঠনালিতে কী এক কষ্ট অবিরাম দলা পাকাচ্ছে। রুদ্রর সঙ্গে একসাথে হাঁটছে সে। অসম্ভব ভালোলাগার এই ছোট্ট অনুপলটিকে কাল বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হয়তো অলীক বলে মনে হবে। তবু আজ এই মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সান্নিধ্যে প্রবল ভালোলাগার যে তার ভেতরে তরল প্রবাহের তুমুল তুফান বইয়ে দিচ্ছে তা সে ভুলবে কী করে!

রুদ্র হঠাৎ দাঁড়াল। ও ঠিক বুঝতে পেরেছে। বিদিতার হাত ওর হাতের মুঠোর মধ্যে নিল আস্তে করে। একটু সময় নিল।
তারপর বলল,
“তোর চোখে জল, তুই কাঁদছিস বিদি! আমাদের দেখা না হলেই বুঝি ভালো হতো!”
বিদিতা নিরুত্তর। তার ভেতরে এতকাল ধরে জমে থাকা কষ্টের পাহাড় তাকে নির্বাক করে দিয়েছে। কথা বলার শক্তি নিঃশ্বেস হয়ে গেছে। তার জন্য রুদ্র আজ একা। তারই জন্য তার ভালোবাসার মানুষটি নিঃসঙ্গ। রুদ্র ঘর পেল না, সংসার করা হলো না ওর। কী কথা বলবে বিদিতা!

রুদ্র পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল বিদিতার দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ওর চোখের পাতায় উষ্ণ ঠোঁট ছোঁয়াল পরম আদরে।
গাঢ় স্বরে বলল, “জানি আর হয় না, তবুও তখন মনটা দুলে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল সব ছেড়েছুড়ে তোকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। বিলিভ মি বিদি, আমি কখনো তোর সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও ছল করিনি। আমার ভালোবাসা ছিল নিখাদ। এখনো তাই-ই আছে। আমৃত্যুই থাকবে।”

আরও পড়ুন গল্প গৃহবন্দি বিড়াল

ট্রেন ছাড়ল । ধীরে ধীরে ফৌজদারহাট পেরচ্ছে ট্রেন। বাইরে কালো পাহাড়ের সারি। যেন জমাট মেঘ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের গায়ে। জমাট মেঘের মতো চাপ চাপ কষ্ট বিদিতার মনের ভেতরও। সে তৃষিতের মতো তাকিয়ে আছে কালো পাহাড়গুলোর দিকে। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দমকে দমকে উঠে আসা নীরব কান্নার জলে ভিজছে বিদিতা। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে এখন শুধুই রুদ্রর তপ্ত ঠোঁটের মোহিত আবেশ।

ট্রেন পাহাড়তলি পেরিয়ে গেল। ট্রেনের গতি এখন কমছে। চট্টগ্রাম পৌঁছচ্ছে ট্রেন। স্টেশনে সুগত অপেক্ষা করছে বিদিতার জন্য। কাল একটি জরুরি অফিসিয়াল মিটিং আছে বিদিতার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর বিদিতা কমলের স্নায়ুর চাপ বাড়ছে। প্রবল স্নায়ুর চাপের সঙ্গে সে প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সে কি পারবে? কাল থেকেই আবার তাকে প্রাত্যহিক দৈনন্দিনতার গ্রাসে ঢুকে পড়তে হবে। আবার সেই একঘেয়ে জীবন। এখান থেকে পালাবার কোনো পথ নেই।

ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে দাঁড়াল। ওরা সবাই স্টেশনে নামল। বিদিতাকে তার স্বামী নিতে এসেছে। রুদ্রর অফিস থেকে জিপ পাঠানো হয়েছে।
যাবার সময় রুদ্র ম্লান হেসে বলল,
“আবার কবে রুদ্র আর বিদির দেখা হবে?”
বিদিতার মুখে পাণ্ডুর হাসি। চোখে জলের আভাস।
বলল,
“আবার হয়তো একযুগ পরে!”

কেউ কারও ঠিকানা চাইল না। তার প্রয়োজনও হয়তো ছিল না। কাল থেকেই আবার ওরা ঢুকে পড়বে নিজ নিজ বৃত্তের ভেতর। আজ এই মুহূর্ত থেকে আবার ওরা দুটি বিচ্ছিন্ন দীপের বাসিন্দা। যদিও ওরা জানে, অব্যক্ত অথচ অদমিত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জেগে থাকবে ওরা আজীবন পরস্পরের বুকের চরায়। জেগে থাকবে ঠিক, যতদিন এই জীবন।

আরও পড়ুন রৌদ্রডোবা চাঁদ-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রৌদ্রডোবা চাঁদ (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

কবি ও কথাশিল্পী আবু জাফর খান নিবিড় অন্তর অনুভবে প্রত্যহ ঘটে চলা নানান ঘটনা, জীবনের গতি প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তিক দহনের সামষ্টিক যন্ত্রণা তুলে আনেন নান্দনিক উপলব্ধির নিপুণ উপস্থাপনায়। তাঁর লেখায় ধ্বনিত হয় বিবেক কথনের অকৃত্রিম প্রতিভাষা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পাথর সিঁড়িতে সূর্যাস্ত বাসনা, অনির্বেয় আকাঙ্ক্ষায় পুড়ি, যে আগুনে মন পোড়ে, যূপকাঠে যুবক, একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, সোনালী ধানফুল, রাতভর শিমুল ফোটে, বীজঠোঁটে রক্তদ্রোণ ফুল, স্যন্দিত বরফের কান্না, প্রত্নপাথর মায়া; গল্পগ্রন্থ: মাধবী নিশীথিনী, পথে পথে রক্ত জবা, উপন্যাস: মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ, জ্যোৎস্নায় ফুল ফোটার শব্দ, কুমারীর অনন্তবাসনা, জ্যোৎস্নাবাসর, মেঘের বসন্তদিন, রূপোলী হাওয়ার রাত, একাত্তরের ভোর, তৃতীয় ছায়া। তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!