মুক্ত ভূমিতে কয়েকদিন // ভ্রমণকাহিনি // তাহমিনা খাতুন
মুক্ত ভূমিতে কয়েকদিন
থাইল্যান্ড বা শ্যামদেশ। ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য! এ দেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। পাহাড়, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, সমতল ভূমি এবং বন-জঙ্গলে ঘেরা থাইল্যান্ড। এক সময়ে এ দেশকে পূর্বের ‘ভেনিস’ বলা হতো।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীর মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এছাড়া ভালো চিকিৎসা নিতেও বহু মানুষ থাইল্যান্ড যাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অনেক বছর আগে, একটি সেমিনারে অংশ নিতে কয়েকদিনের জন্য থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন থাইল্যান্ডের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে জেনেছিলাম।
উড়াল সড়কের শহর ব্যাংকক। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে মূল শহর পর্যন্ত দীর্ঘ পথ উড়াল সড়কের উপর দিয়েই যেতে হয়। তারপরও বেশ যানযটের ধকল সামলাতে হয়। সারা শহর জুড়েই অসংখ্য উড়াল সড়ক।
ব্যাংকক বিমানবন্দর বিশাল। আমি যখন ভ্রমণ করেছিলাম, সে সময় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হিসাবে এর অবস্থান ছিল প্রথম দিকে। যাহোক, বিমানবন্দরে অবতরণের পর সোজা হেঁটে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে গেলাম। এ সময়ে বিমানবন্দরের কোনো ব্যক্তি আমাকে বাধা দিল না! বের হওয়ার পর খেয়াল হলো, আমার পাসপোর্টে সিল পড়ে নাই। আবার দৌড়ে ভেতরে ঢুকে ইমিগ্রেশনে গিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারকে জানালাম, আমার পাসপোর্টে সিল দেওয়া হয়নি। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে চার্জ করল, আমি পাসপোর্টে সিল না দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েছি কেন। আমিও তাকে বললাম, তোমরা আমাকে থামাও নাই কেন? নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ইমিগ্রেশনের লোকজন আর কথা বাড়ালো না। পরে শুনেছিলাম শুধু মাত্র আমার নয়, অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণ কাহিনী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে
ভ্রমণটি ছিল অফিসিয়াল। আমাকে এবং আমার সহকর্মীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরের বাইরে কয়েকজন থাই নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছিলেন। আমরা বের হওয়ার পর, আমাদের সবার ছবি তুলে তাঁরা হোটেলের বাসে তুলে দিলেন।
‘থাইল্যান্ড’ শব্দের অর্থ ‘মুক্ত ভূমি’। বিভিন্ন সময়ে থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ান, মালয়ি, বার্মিজ শাসকদের দ্বারা শাসিত হলেও ব্রিটিশ, ফরাসি বা পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো কোনো শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়নি! ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা শাসিত না হওয়ার কারণে থাইল্যান্ডের সম্পদ লুট হয়ে দেশের বাইরে চলে যায়নি। এ কারণে থাইল্যান্ডকে মুক্ত ভূমি বলা হয়।
১৩০০ শতাব্দীতে থাই জাতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। থাইল্যান্ডের প্রাচীন নাম ‘সায়াম’ বা শ্যাম। প্রায় ৪ শত বছর ধরে থাইল্যান্ড ‘সায়াম’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৩৯ খ্রি. পর্যন্ত থাইল্যান্ডের নাম ছিল ‘সায়াম’ বা শ্যাম। শ্যাম একটি পালি শব্দ। এর অর্থ ল্যান্ড অব গড বা ঈশ্বরের ভূমি। আবার অনেকের মতে, সংস্কৃত শান ও আ-হম শব্দ থেকে শ্যাম শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ অন্ধকার। ঈশ্বরের ভূমি কেন অন্ধকার হবে—এটা বিস্ময়করই বটে! কাজেই এই নামকরণের উৎস ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যাহোক, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের পর এদেশের শাসকরা আবারও সায়াম বা শ্যাম নামে ফিরে যায় এবং ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে শেষ বারের মতো থাইল্যান্ড নাম গ্রহণ করে এবং অদ্যাবধি এই নামেই পরিচিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী আমি ভিআইপি?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড বিভিন্ন জাতির সম্মিলনে গড়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডের জনসংখ্যার ৭৫-৭৮ ভাগ থাই, ১৪ ভাগ থাই চাইনিজ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। থাইল্যান্ডের ৯৫ ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ৪০ ভাগ মানুষ থাই ভাষায় কথা বলে। অন্যান্য উপভাষায় কথা বলে ৫০ ভাগ মানুষ। বাকি ১০ ভাগ মানুষ অন্যান্য উপভাষায় কথা বলে। এ দেশে প্রায় ৭০টি ভাষা প্রচলিত! থাইল্যান্ডের ধ্রুপদী সঙ্গীত, নৃত্য এবং লোকশিল্প পৃথিবী বিখ্যাত।
চাও ফ্রেয়া নদীর তীরে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। সন্ধ্যার পরে জেগে ওঠে এক নতুন শহর। রাতে আমাদেরকে চাও ফ্রেয়া নদীতে রিভার ক্রুজ করতে নিয়ে যাওয়া হলো। বিভিন্ন ধরনের থাই খাবারে আপ্যায়ন করার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। থাই নারী-পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান দারুণ উপভোগ্য ছিল।
ব্যাংকককে মন্দিরের শহর বলা যায়। থাইল্যান্ডে প্রায় ৩৫০০০-৪০০০০ বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংককেই রয়েছে প্রায় ৪০০ বৌদ্ধ মন্দির। প্রমাণ মিলবে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বেড়াতে গেলেই। শহরের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে ছোটো-বড়ো অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন ভঙ্গিমার মূর্তি।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
ব্যাংককের সবচেয়ে সুন্দর আর প্রাচীন রাজপ্রাসাদ হলো ‘গ্রান্ড প্যালেস’। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই প্রাসাদে বিভিন্ন সময়ে রাজা-রানিগণ বসবাস করেছেন। ২৩, ৫১,০০০ বর্গ ফুট জায়গা নিয়ে এই প্যালেস তৈরি করা হয়েছিল। এখানে স্থাপন করা হয় ২৬ মিটার উচ্চতার সবচেয়ে বিখ্যাত জেড পাথরের বুদ্ধের মূর্তি।
ওয়াট আরুণ বা রাইজিং সান টেম্পল বা সূর্যোদয়ের মন্দির আরেকটি বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির। সবচেয়ে বড়ো এবং প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির হলো ওয়াট ফো। ৮০,০০০ স্কয়ার মিটার দীর্ঘ এ মন্দির সবচেয়ে প্রাচীন। এখানে প্রায় হাজার খানেক বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এর মধ্যে এক পাশ হয়ে শোয়া অবস্থায় সোনার প্রলেপ দেওয়া তৈরি বুদ্ধ মূর্তির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫১ ফুট। এমনভাবে মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে যেন গৌতম বুদ্ধ একটা হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে আছেন।
‘ওয়াট ট্রাইমিট’ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ খাঁটি সোনার তৈরি বুদ্ধ মুর্তি। এর ওজন পাঁচ টন! আমরা যখন এই বুদ্ধ মূর্তি দেখতে গেলাম, আমাদেরকে জানানো হলো, কিছুদিন আগেই এই মূর্তি স্থাপনের জন্য বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করে সম্পূর্ণ নতুন করে এই মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছে। মন্দির নির্মাণ শেষ হলে বুদ্ধ মূর্তিটি সেখানে প্রতিস্থাপিত হবে।
ইতালিতে যেমন অজস্র অর্থ ব্যয় করে জাঁকজমকপূর্ণ অসংখ্য গির্জা নির্মাণ করা হয়েছিল, তেমনি থাইল্যান্ডেও বহু অর্থ ব্যয়ে বৌদ্ধ মন্দির এবং গৌতম বুদ্ধের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প
থাইল্যান্ড চামড়ার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর জন্য বিখ্যাত। ব্যাংককের বড়ো বড়ো শপিং মল থেকে শুরু করে ফুটপাতেও দোকানীরা চামড়ার তৈরি জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ ইত্যাদি সাজিয়ে বসে থাকে। শুধু চামড়ার তৈরি জিনিসপত্র নয়, ব্যাংককের ফুটপাতে ঢাকার মতোই চশমার ফ্রেম, পোশাক, প্যাকেট করা কাটা কাঁচা মিঠা আম, মিষ্টি তেঁতুল, রঙিন জামরুল ইত্যাদি হরেক রকমের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তবে দামাদামি না করে কিনলে ঠকার আশঙ্কাও আছে। একটা বিষয় পর্যটকদের অবাক করে তা হলো, সন্ধ্যা ছয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শপিং মলগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং দোকানীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে দোকানের সামনের ফুটপাতে নেমে গিয়ে পশরা সাজিয়ে বসে যায় এবং গভীর রাত পর্যন্ত বেচা-কেনা চালিয়ে যায়।
ব্যাংকক আসলে রাতের শহর। গভীর রাতে শুরু হয় বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লারের কর্মকাণ্ড। কাজেই দিনে-রাতে সব সময়ই সরগরম এ শহর।
একদিন আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো দুস্থ-অসহায় নারী-শিশুদের জন্য তৈরি ব্যাংককের একটি আশ্রয়কেন্দ্র দেখাতে। আমাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্রটি ঘুরে দেখালেন আশ্রয় কেন্দ্রের ম্যানেজার। আমাদেরকে এক বোতল খাবার পানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। আমাদের মতো দেশি-বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য অর্থ খরচ করা হয় না। অনেকগুলো শিশু-কিশোর-কিশোরীকে দেখলাম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, কারিগরি শিক্ষা—সব কিছুরই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এই আশ্রয় কেন্দ্রে।
আরও পড়ুন আমাদের আত্রাই নদী
থাইল্যান্ডের আয়তন ১,৫৮,০০০ এর মতো কিন্তু এখানে রয়েছে অনেকগুলো আকর্ষণীয় সমুদ্রতট যেগুলো ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ব্যাংককের নিকটবর্তী সমুদ্রতীরের শহরটির নাম পাতায়া। ব্যাংকক থেকে মাত্র এক শত পঞ্চাশ মাইল দূরের এই অপরূপ সুন্দর সমুদ্র সৈকতের তীরবর্তী শহরটি দেখতে গেলাম। এক সময়ে পাতায়া ছিল মূলত ছোটো একটি জেলে পাড়া। ১৯০০-১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে মৎসজীবীদের প্রাধান্য থাকলেও ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ( যে যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সাহায্য করার জন্য আমেরিকা সরাসরি সৈন্য পাঠায়) যুদ্ধ ক্লান্ত আমেরিকান সৈন্যরা অবসর কাটানোর জন্য সমুদ্র তীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানটিকে বেছে নেয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই ‘পাতায়া’ একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়। সারাদিন পাতায়ার অপরূপ সৌন্দর্য্যের মাঝে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় আমরা আবার ব্যাংকক ফিরে গেলাম।
ব্যাংকক শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন। প্রশস্ত রাস্তা। যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ ভালো। ফুটপাতের উপরেই ভারত, নেপাল ও থাই খাবার কিনতে পাওয়া যায়। এসব খাবার বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্যাকেটে করে বিক্রি করা হয়। এসব খাবারের বেশ চাহিদা রয়েছে।
থাইল্যান্ডের আবহাওয়া বাংলাদেশের মতোই। বছরের বেশিরভাগ সময় উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। ডিসেম্বরে মোটামুটি আরামদায়ক আবহাওয়া।
থাইল্যান্ডে কয়েকদিন কাটিয়ে আবার নিজের দেশে ফিরে এলাম আমরা।
ঘুরে আসুনআমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
মুক্ত ভূমিতে কয়েকদিন