পক্ষিরাজের ডানা (৩য় পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (৩য় পর্ব)
পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর যথারীতি রেজাল্ট বেরুলো। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেল জানে আলম শুধুমাত্র বাংলা ছাড়া আর সবগুলো বিষয়েই ফেল করেছে। স্কুলের হেড মাষ্টার আবুল কাশেম জানে আলমের বাবা মাজেদ শেখকে স্কুলে ডেকে পাঠালেন। তাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
__ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দিতে পারো না তো ওদের স্কুলে পাঠাও কেন মাজেদ মিয়া। ক্ষেত খামারে কাজে লাগালেও তো এর চেয়ে বেশি লাভবান হতে।
কথাগুলো যে প্রধান শিক্ষক বিদ্রুপাত্মক সুরে বলছেন মাজেদ শেখের সেটাও সম্ভবত মাথায় ঢোকে না।
__ঠিকই কয়ছেন মাষ্টার সাব। আমিও তাই ভাবতিছি ওক আমি মাটেই লাগা দেবো। ক্ষেত-জমি চাষ করুক। ফসল ফলাক নয়তো গরু রাহুক। লেহাপড়া ওর হবি নানে এ আমি বুঝি ফালাইছি।
আবুল কাশেম মাজেদ শেখকে কষে ধমক দিয়ে বললেন,
__যাও মিয়া বাড়ি যেয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দাও। তোমাকে আর ওকে মাঠে পাঠাতে হবে না। ওদের লেখাপড়ার ভালো পরিবেশ দাও। প্রতি বছর জমি না কিনে সে টাকা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে বিনিয়োগ করো। পরে পাছে ভালো ফল পাবা। ওরাই তোমার আসল সম্পত্তি। মাঠের জমি আজ আছেতো কাল নাই কিন্তু ছেলেপুলে গুলো মানুষ হলে সারা জীবন কাজে লাগবে। তোমার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। দু’একটা গৃহ শিক্ষক রাখতে হলে রাখো। এভাবে চললে আলম কিন্তু মেট্রিক পাশ করতে পারবে না। এ আমি আগে ভাগেই বলে দিচ্ছি।
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
হেড মাষ্টার আবুল কাশেমের মুখে এসব কথা শুনে বিরস বদনে বাড়ি ফেরেন মাজেদ শেখ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুখে জানে আলমকে হাতের কাছে পেয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি।
__কী রে আলম, আমি কী টাহা পয়সা কম খরচ করতিছি। তুই বাংলা ছাড়া আর সব বিষয়ে ফেল করলু ক্যা? পড়লি ভালো কইরে পড়। না হলি পড়া ছাড়ান দিয়ে মাটে যা, ক্ষেত চাষ কর। গরু রাখ। আইজ তোর জন্যি মাষ্টারের মুখতিন এতোগুলো কতা আমার শুনা লাগলি।
জানে আলমও চেঁচিয়ে উত্তর দেয়,
__আমি কী করবো। স্যারেরা পার্সিয়াল্টি করেছে। আমাক ইচ্ছে করে ফেল করাইছে।
__তোক ইচ্ছে কইরে ফেল করাইলো। সেইডে ক্যামন কইরে আমাক ইটু বুঝা কতো দেহি।
__কী আর কব, অংকের টিচার বদিউর স্যার শান্তিপুরতিন স্কুল করে রোজ সাইকেল কইরে। প্রত্যেকদিনই আমাক ডাইকে কয় ওরে আলম দেখতো দেহি বাবা আমার সাইকেলের চাকা দুইডে ক্যাঁদো লাইগে এহেবারে নষ্ট হয়া রইছে। হালটের (রাস্তা) পাশে মাইটেলতিন (পুকুর) আমার সাইকেলখান ভালো কইরে ধুয়ে নিয়ে আয় তো বাপ।
জানে আলম মাজেদ শেখের দিকে তাকিয়ে উষ্মা মিশেল কণ্ঠে বলে,
__আব্বা আপনেই কন রোজ রোজ কি এসব করতি ভালো লাগে। দুই তিন দিন করার পর একদিন আমি কলাম-রোজ রোজ আমি এইসব কইরবের পারবো না স্যার। আমাক আপনি মাপ করেন। এহন আপনি কন আমাক উনি পাশ করাবি না কী ফেল করাবি?
__ধর্মের ওবায়দুর স্যার দুই তিন মাস আগে একদিন আমাক ডাইকে কলো, ওরে আলম ক্লাস শেষ হলি আমার বাড়ি আসিস তো ইট্টু বাবা। ছাগল দুইডের জন্যি মাটতিন কিছু ঘাস কাটা লাগবি। উনার ছাগলের জন্যি ঘাস কাইটে দিছি পাঁচ-সাত দিন। তারপর দেহি রোজই আমাক ডাহে। আমি একদিন কলাম, স্যার আমার কী আর কোন কাজ কম্ম নেই। আপনি ক্লাসের অন্য কাউকে ডাকেন। আমি রোজ রোজ আপনার ছাগলের জন্যি ঘাস কাইটপের পারবো না। আমি শিওর যে, উনি এই জন্যি আমাক ফেল করায়ছে। আমি যত খারাপ ছাত্রই হই, ধর্মে ফেল করা ছাত্র এই জানে আলম না। এ আমি জোর গলায় কবের পারি।
আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা
এভাবে জানে আলম প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু অভিযোগ আনলো। যে কারণে জানে আলম মনে করে শিক্ষকগণ তাকে ইচ্ছে করেই ফেল করিয়েছে। মাজেদ শেখ এবার তার ছেলের দিকে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলো,
__ইংরেজি যেন কে নেয় রে আলম?
__কে আবার, আমারে হেড স্যার আবুল কাশেম। সব ক্লাসে ইংরেজি তো উনিই পড়ান।
__আবুল কাশেম মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। তাছাড়া উনি তো দেহি সবসময় তোর ভালো চায়। তয় তুই ইংরেজিতে ফেল করলি ক্যান?
জানে আলম কষ্মিন কালেও ভাবেনি তার পিতা মাজেদ শেখ এরকম একটি ব্রহ্মাস্ত্র তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবে। বাবার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর কিছু সময় চুপ করে রইলো জানে আলম। শুধুমাত্র এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠোনের বেলে মাটি গুলো সব তুলতে লাগলো।
__কী রে আলম কতা কইসনে ক্যা এহন? কতা কী সব ফুইরে গেলো এতো তাড়াতাড়ি?
__ইংরেজিত আমি ছোট বেলাতিনই দুর্বল। আপনাক আমি অনেকবার কইছি আমাক একটা ইংরেজির টিচার রাহি দেন। আপনি তো কোনোদিনও এটা প্রাইভেট টিচার রাহি দিলেন না। ফেল করবো না তো কী করবো?
মাজেদ শেখ আশ্বস্থ হলেন এই ভেবে যে, যাক ছেলেটি তাহলে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিলো যে তারও লেখাপড়ায় গাফলতি আছে। প্রথম দিকে অবশ্য তার ইচ্ছে হয়েছিলো জানে আলমের গালে কষে কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দিতে। কিন্তু কি ভেবে পরক্ষণেই সেই ইচ্ছে ত্যাগ করতে পেরেছিলো মাজেদ শেখ। ঘণ্টা খানেক সময় ধরে ছেলেকে ওয়াজ নসিয়ত করলেন লেখাপড়ায় মন দিতে। আর ভালো করে লেখাপড়া না করলে তার শেষ পরিণতি যে গরুর রাখাল হিসেবে সেটাও তিনি তার পুত্র জানে আলমকে মনে করিয়ে দিলেন বার বার।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
পরীক্ষার ফল প্রকাশের দু’চার দিনের মধ্যেই পুনরায় ক্লাস শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। আবুল কাশেম পরপর দু’তিন দিন খেয়াল করে দেখলেন- জানে আলম ক্লাসে অনুপস্থিত। প্রথম ক্লাসটি যেহেতু আবুল কাশেমই নেন সেহেতু রেজিষ্টার খাতাটি তিনি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন- হ্যাঁ এই তো, তার তো ভুল হবার কথা নয়। খাতাটিতে এ্যাবসেন্টের তিনটি ‘এ’ যুক্ত মার্ক জ্বলজ্বল করছে। তিনি ভেবে পেলেন না, ক্লাসে আসছে না কেন জানে আলম। অসুখ বিসুখ করেনি তো আবার। গ্রীষ্মের এই সময়টাতে চারদিকে জ্বর-সর্দির ব্যাপক প্রকোপ। আবুল কাশেম মনে মনে ভাবলেন মাজেদ শেখকে আবার তলব করার সময় হয়েছে।
পরদিন আবুল কাশেম যথারীতি ক্লাসে ঢুকে রোল কল প্রায় শেষ করে এনেছেন, ঠিক সে সময় জানে আলম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
__মে আই কাম ইন স্যার।
আবুল কাশেম মাথা ঘুরিয়ে জানে আলমের দিকে তাকিয়ে মাথাটি ঈষৎ নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। রোল কল শেষে আবুল কাশেম রেজিষ্টার খাতাটি বন্ধ করে সেটা সরিয়ে রাখলেন টেবিলের একপাশে। তারপর জানে আলমের দিকে তাকিয়ে অনেকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
__আলম এদিকে আয় একটু। তোর সঙ্গে আমার বিশেষ কিছু কথা আছে।
জানে আলম কল দেয়া যান্ত্রিক পুতুলের মত আবুল কাশেমের চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
__তোকে কতবার করে বলেছি লেখাপড়ায় ভাল করে মন দে। তোকে বলে বলে যখন কোন ফল পেলাম না তখন তোর বাবাকে ধরে কতটা অনুনয়-বিনয় করে বললাম ছেলেটাকে ভাল করে লেখাপড়া করাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তুই দু’তিন দিন ক্লাসে অনুপস্থিত। এর কারণ কী? কেন আসিসনি ক্লাসে?
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
জানে আলম মেঝের দিকে তাকিয়ে শোকার্ত কণ্ঠে বলল,
__আমাদের একটি ভাই হয়েছিল তিন দিন আগে, লাল রঙের।
ক্লাসে একেবারে সামনের বেঞ্চে একটি টকটকে লাল রঙের শার্ট গায়ে বসেছিল ছালেক। জানে আলম সেদিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
__এহাবারে ওই রহম লাল। কিন্তু জানেন স্যার, ভাইডে আমার মইরে গেল। ভাই মারা গেলি বাড়ির অবস্থা যা হয়। মা তো উঠোনে গড়াগড়ি কইরে কান্না। সেই কান্না আর থামে না। বাবা বেল তলা বইসে ঝিমায়। রান্না-খাওয়া নাই, গা-গোসল নাই। আর স্কুলি আসি ক্যামন কইরে?
আবুল কাশেম কৌতুহলী কণ্ঠে বললেন,
__তোর তাহলে একটা লাল রঙের ভাই হয়েছিল, তাই তো? কিন্তু মাস সাতেক কি আটেক আগে তুই যে একদিন বললি তোর একটা নীল রঙের ভাই হয়েছিলো। সেটাও কী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?
জানে আলম আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে,
__আমার নীল রঙের ভাইডাও মারা গেছিলো জন্মানোর একদিন পর। তহন ও মা কাদতি কাদতি অজ্ঞান হয়া গেছিলো। তিন চার দিন মুহি কোন দানা পানি দেয় নাই। সাথে আমরা ম্যালা কান্নাকাটি কইরেছিলাম আমারে ভাইডের জন্যি।
__তো এরপর তোদের যে ভাই হবে, সেটা কী সবুজ রঙের হবে না কী হলুদ?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জানে আলমের কথাগুলো বিমিশ্র ও পরস্পর বিরোধী। তাই শুধু জানে আলমের ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, গ্রামের মুরুব্বী ও শ্রদ্ধা ভাজন ব্যক্তিরাও জানে আলমের কথায় সবসময় ভরসা রাখা যায় না।
আরও পড়ুন গল্প তিলতাল
আবুল কাশেম জানে আলমকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
__কী রে আলম বললি না যে, এরপর তোদের যে ভাইটি হবে সেটা সবুজ না হলুদ হবে?
জানে আলম এবার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
__আমি কি কইরে কব কী রঙের ভাই হবে? ইডা তো আল্লাই কবির পারে। আপনি কি আমার কথা বিশ্বেস করতিছেন না?
জানে আলমের ঝাঁঝালো কণ্ঠের কারণেই হবে হয়তো, আবুল কাশেমের মাথায় রোখ চেপে গেল। তিনি জানে আলমের ডান কানটি বাঁহাতে হির হির করে টেনে তার নাগালের মধ্যে নিয়ে এলেন।
__এবার বল দেখি তোর কত গাল-গপ্প আছে শুনি। লাল রঙের ভাই, নীল রঙের ভাই। আমাদেরকে তোর উল্লু মনে হয়, তাই না?
__আহ্ কী করতিছেন, কানে ব্যাথা পাচ্ছি তো।
এই বলে জানে আলম এক ঝটকায় আবুল কাশেমের হাতটি সরিয়ে দিলো তার কান থেকে। জানে আলমের এহেন বেয়াদপিতে আবুল কাশেমের ব্রহ্মতালুতে যেন অগ্নি সংযোগ ঘটল। আবুল কাশেম অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললেন,
__এই ফজু লাইব্রেরী রুম থেকে ভাল দেখে দুটো বেত নিয়ে আয় তো জলদি।
আরও পড়ুন গল্প কবর
ফয়েজ সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরী ঘর থেকে দুটো বেত এনে তুলে দেয় আবুল কাশেমের হাতে। আর ওমনি আবুল কাশেমও বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে জানে আলমের ক্ষুদ্র শরীরটির উপর। বেত্রাঘাতের এই তাণ্ডব লীলা চলে বেশ কিছু সময় ধরে। মার খেতে খেতে জানে আলম এক সময় মুর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। ইতোমধ্যে আবুল কাশেমও যেন কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পান। এ কী করছেন তিনি। রাগে অগ্নিভ হয়ে তিনি যেন অন্য কোন এক দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল তার। নিজেকে নিবৃত করে, গিয়ে বসলেন চেয়ারটাতে। দু’এক জন বিদ্যার্থীর দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করলেন জানে আলমকে তুলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
চেয়ারে বসে আবুল কাশেম টের পেলেন ছাত্র-ছাত্রীদের পেটানোটাও কতটা কায়িক পরিশ্রমের কাজ। জানে আলমকে পেটাতে গিয়ে আজ কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। অথচ যখন তার যৌবন ছিল তখন নিদেনপক্ষে সপ্তাহে দু’চারটি বেত ছাত্রদের পিঠে ভেঙ্গে সুখ করতেন হাতের। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আজ জানে আলমের কাতরানিতে তিনি যেন একটু ব্যাথিত হলেন। মনের এক কোণে কিঞ্চিৎ অনুসূচনা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে হঠাৎ উঁকি দিয়ে গেল। নাহ্ আজ আর তিনি ক্লাস নেবেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন শ্রেণীকক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন পক্ষিরাজের ডানা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পক্ষিরাজের ডানা (৩য় পর্ব)