পক্ষিরাজের ডানা (২য় পর্ব)
পক্ষিরাজের ডানা (২য় পর্ব)
পূর্ব-দক্ষিণ কোণে কুচকুচে কালো মেঘ। ভাবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের ঝড় আসবে শীঘ্রই। এক পাল সাদা বক পূর্ব দিক থেকে উড়ে যায় পশ্চিমে। পূর্বদিকের কোন অঞ্চলে হয়তো ইতোমধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আর সেজন্য পাখ-পাখিরা দল বেঁধে সব পালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে। আসন্ন বিপদের আঁচ পেয়ে গরুগুলোকে নিয়ে জানে আলম বাড়ির পথে পা চালায় দ্রুত।
জানে আলম তার গরুগুলোকে উঠোনের শেষ প্রান্তে খড়ের গাদার পাশে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেয় শক্ত করে। বাড়ির ভেতর থেকে জানে আলমের বাবা মাজেদ শেখ চিৎকার করে ওঠে “তোর কি কোন জ্ঞান কাণ্ড নেইরে আলম, গরু গুলেক তুই উটোনে বাঁধলি। ঝড়-সাপট উইটে আসতিছে। গরু গুলেক গোয়ালে নিয়ে বাঁইদে দে। পয়দা কইরেছি এক আহাম্মক”। বাবার চিৎকার চেঁচামেচিতে তড়িঘড়ি করে গুরুগুলোকে নিয়ে গোয়াল ঘরে বেঁধে দেয়, তারপর কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে পড়তে বসে জানে আলম।
অনেকগুলো ভাই-বোনের সমাহার তাদের পরিবারে। বড় বোন হাফিজার বিয়ে হয়ে গেছে অল্প বয়সে, পাশের গ্রাম নদ্দিপুরে। হাফিজার পরের বোন নাফিজা, দু-দু’বার মেট্রিক ফেল করে এখন মায়ের সাথে ঘরদোরের কাজ কর্মে হাত লাগায়। নাফিজার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বাবা মাজেদ শেখ গ্রামের পেশাদার ঘটক আলিমুদ্দিকে পরিতোষিক হিসেবে কিছু টাকা-পয়সাও তুলে দিয়েছে তার হাতে। এখন মোটামুটি ধরনের যে কোন একটি ভাল গেরস্থ্য ঘরের ছেলে পেলেই নাফিজাকে শীঘ্র জামাইয়ের ঘরে পাঠানো যায়।
আরও পড়ুন গল্প সাদা কাগজে প্রেম
ভাই-বোনদের মধ্যে জানে আলম তৃতীয়। ভাই দু’জনের মধ্যে অবশ্য সে সবার বড়। জানে আলমের পর যে বোনটি, তার নাম রাহেলা। জানে আলমের চেয়ে বছর খানেক ছোট হবে। কিন্তু ও পড়ে জানে আলমেরও দু’ক্লাস নিচে। তারপরের বোনের নাম হালিমা। হালিমার মাথাটা বেশ পরিস্কার। ক্লাস ফাইভে ও ট্যালেন্ট ফুলে বৃত্তি পেয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত একবারের জন্যও হালিমা দ্বিতীয় হয়নি। প্রত্যেক ক্লাসেই ও প্রথম। স্কুলের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই হালিমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। পড়াশোনাটা ঠিকঠাক মত চালিয়ে যেতে পারলে জীবনে হয়তো অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারবে সে। আর সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের নাম রঞ্জু। ওর বয়স মাত্র তিন বছর। যদিও কথাবার্তা কিছু বলে বটে কিন্তু সম্পূর্ণরূপে মুখের আড় কাটেনি এখনো।
এতগুলো ভাই-বোন সঙ্গে মা-বাবা নিয়ে দু’রুমের একটি ঘরে বসবাস তাদের। মাজেদ শেখ নিতান্তই গরিব কৃষক। অনেক কায়ক্লেশে শুধুমাত্র মুখের আহার জোটে কোন মতে। পরিবারের সবার পড়াশোনার খরচ যোগানো তার জন্য অনেকটা বিলাসিতা পর্যায়ের। দুটি কামড়ার কোন একটির এক কোণে পড়ার জন্য স্থান খুঁজে নিতে হয় জানে আলমের। আশে-পাশের প্রায় সব বাড়িতেই ইলেক্ট্রিসিটির বাতি জ্বলে। কিন্তু তাদের ঘরে আজও জ্বলে হারিকেন। এজন্য পরিবারের প্রায় সব ভাই-বোনেরা আক্ষেপ ও উষ্মা প্রকাশ করলেও মাজেদ শেখের সাফ জবাব, যেখানে বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি নিয়েই বা কী লাভ। মোটের ওপর মাসে মাসে অতিরিক্ত কিছু বিল চুকানোর উটকো দায়ে নিজেকে আবদ্ধ করা।
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
জানে আলমের মতো দরিদ্র পরিবারে রাতের আহার পর্বটি চুকে যায় সন্ধ্যা নামার পরপরই। তারপর কিছু সময় ঘরের এক কোণে বই নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমুনি। এরপর শুতে যাওয়া বিছানায়। বিছানা বলতে মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে টানা বিছানা। রঞ্জুকে নিয়ে মাজেদ শেখ ও জুলেখা বিবি শোয় একটি কামড়ায় আর অন্যটিতে থাকে জানে আলম ও তার তিন বোন। সকাল সকাল স্কুলে যেতে হয় বলে জানে আলমকে শুয়ে পড়তে হয় তাড়াতাড়ি। মাজেদ শেখ ও ভোরে উঠে চলে যায় জমিতে আবাদ করতে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানে আলম ভাবে, আজ এতগুলো পক্ষিরাজ ঘোড়া কী সত্যি সত্যি আকাশ থেকে নেমে এসেছিলো ভিটেতে! না কী ওগুলো সবই ছিল স্বপ্ন। না.. না… এত জীবন্ত দৃশ্য স্বপ্ন হয় কী করে?
হঠাৎ পাশের কামড়া থেকে মাজেদ শেখ আর জুলেখা বিবির কথা শোনা যায়। যদিও তারা কথা বলছিলো নিচু স্বরে তারপরও তাদের কথাগুলো শোনা যাচ্ছিলো অবলীলায়। জুলেখা বিবি ফিসফিস করে বলল, “আরে কী করতিছো। ছাওয়াল, মিয়া গুলেতো এহনো ঘুমায়নি”।
মাজেদ শেখের কণ্ঠে উষ্মা “না ঘুমালি আমি কী করবো। আমার বুঝি আর কোন কাম কাইজ নাই। আমার তাড়াতাড়ি ঘুমান লাগবি। ভোরে উইটে ক্ষেতে যাওয়া লাগবি। দুই বিঘে ভূঁই চষা লাগবি”। জুলেখা বিবি মাজেদ শেখকে থামানোর প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে রণেভঙ্গ দিতেই হয় তাকে।
আরও পড়ুন গল্প অচেনা
চরদুলাই বি. আর উচ্চ বিদ্যালয়টি জানে আলমের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। মিনিট দশ-বারোর হাঁটা পথ। বেশিরভাগ দিন জানে আলমই স্কুলে পৌঁছায় সবার আগে। তারপর অন্য ছাত্ররাও আসে এক এক করে। নবম শ্রেণির ছাত্র জানে আলম। বছর দুয়েক পরেই মেট্রিক পরীক্ষায় বসতে হবে তাকে কিন্তু পড়াশোনায় একেবারেই মন নেই তার। ভালো লাগে শুধু গল্পগুজব করতে। এজন্য ক্লাসের সবাই তার নাম দিয়েছে ‘গল্পবাজ’। গল্প বলায় এমন ওস্তাদ বালক বোধকরি অত্র গ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই। যে কোন তুচ্ছ ঘটনা সে এমন জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও নিপুণ শৈলিতে বয়ান করে যে সেগুলো শোনার পর মনে হবে যেন এর চেয়ে সত্য বুঝি আল্লাহর জমিনে আর কিছু হতে পারে না। জানে আলম যখন কোন ঘটনার গুণ কীর্তনে মত্ত হয় তখন মনে হয় যেন সেটি একটি মধুতীর্থ। আবার যখন সেই একই জানে আলম কোন কিছুর নিন্দাচর্চা শুরু করে দেয় তখন সেটা হয়ে ওঠে কেউটে সাপের বিষের চেয়েও বিষাক্ত।
ময়রার দোকানে ঝুলন্ত সন্দেসের চারপাশে মাছি যেভাবে ভন ভন করে, জানে আলমের গল্পের আসরেও সেরকম নিয়মিত ও মজ্জামান কিছু শ্রোতা সবসময় তার পিছু করে। যে কোন গল্প বলার সময় বিশেষ করে মতি, বিশু, ফয়েজ, ছানা, নিরাল সবসময়ই তার গল্পের নিত্য সঙ্গী। শুধু তা-ই নয় ক্লাসের অন্যান্য ছাত্ররাও তাকে ঘিরে থাকে বেষ্টনির মতো করে। জানে আলমের বয়ানকৃত বেশিরভাগ গল্পই হয়তো তাদের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করে না। তবে নিঃসন্দেহে সবাই যে তার গল্পের বিশেষ অনুরাগী ও উপভোগী সেটা ছেলেগুলোর চোখ মুখ দেখলে সহজেই বোঝা যায়।
আরও পড়ুন গল্প ভাঙা গড়ার টান
যথারীতি আজও জানে আলম ক্লাসে এসেছে সবার আগে। অপেক্ষার প্রহর যেন আর কিছুতেই শেষ হয় না। কখন আসবে তার গুণমুগ্ধ সব সঙ্গী। তারা একে একে সবাই যখন এসে উপস্থিত হয় ক্লাসে, জানে আলমও তখন উন্মুক্ত করে দেয় তার গল্পের ঝাঁপি। ঘোড়ার ভিটেয় গতকালের সব অলৌকিক ও অদ্ভুতুরে ঘটনাগুলো বর্ণনা করে সবিস্তারে। এসব গল্প শুনে জানে আলমের সতীর্থ বন্ধুরা সব হতভম্ব। এও কী হতে পারে! জানে আলমের এসব কল্পকাহিনী তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।
গল্পের রেশ কাটতে না কাটতেই ক্লাসে প্রবেশ করে ইংরেজির শিক্ষক আবুল কাসেম। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা প্রায় আসন্ন। আর সে জন্যই বোধ করি তিনি রোল কল শেষ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
আরও পড়ুন পক্ষিরাজের ডানা-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পক্ষিরাজের ডানা (২য় পর্ব)