নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। শেষ পর্ব ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। এ কে আজাদ দুলাল
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। শেষ পর্ব
- এ কে আজাদ দুলাল
রাশিদ নির্বাক। কী করবে এখন। কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পঞ্চাশ বছর পর। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে কী করতেন। বাবা-মায়ের অবর্তমানে মেজো ছেলে হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। আমাদের ধর্মে সন্তান ত্যাজ্য করার কোনো বিধান নেই। তাই বাবা করতে পারেননি। আবার এটাও হতে পারে যতদোষ করুক সে তো ঔরসজাত প্রথম সন্তান। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কে ছেদ পড়ে যায়। কিন্তু তার বড়ো ছেলের প্রাপ্ত সম্পদ হতে বঞ্চিত করে যাননি। তারাই ব্যবহৃত ঘরটি রেখেছেন যদি বড়ো ছেলের কোনো ওয়ারিশ দাবি করে। বড়ো ভাইয়ের ওয়ারিশ ঠিকই এসেছে, কিন্তু সে তো এখনো জানে না এখানে তার কী পরিচয়। বাবা বড়ো অভিমানী ছিলেন তার সুযোগ্য মেধাবী সন্তানের ওপরে। বাঙালি ঘরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ একজন ছেলে হয়ে অপরিচিত অবাঙালি ঘরের উর্দুভাষী মেয়েকে বিয়ে করাতে। যাদের শেকড় পশ্চিম পাকিস্তানে এখানে ব্যবসা এবং আধিপত্য স্থাপনের জন্য সুকৌশলে ঢাকায় বসবাস। এখানেই বাবার অভিমান। ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্বশুরের হাত ধরে বউকে নিয়ে বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। ফিরে তাকাল না ছোটো তিনটি ভাই-বোন আর বাবা-মায়ের দিকে। আবার ফিরে এলো স্বাধীনতার তিন বছর পর; চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে। কী কঠিন সময় পার করছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আর জনগণ। চারদিকে গভীর ষড়যন্ত্র। এর মধ্যে ফিরে এলো সিএসপি আমলা রাকিব আহমেদ। চাকরিতে পুর্নবহাল হলেন। শ্বশুরের বাড়ি উদ্ধার করলেন। পঁচাত্তরের ভাগ্য খুলে যায় রাকিব আহমেদের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে যোগদান করেন আর তাকাতে হয়নি রাকিব আহমেদের। সব কিছু জানতেন রাকিব আহমেদের কলেজ জীবনের বন্ধু ডা. নাজিম। যিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের সাহায্য করেছিলেন। বিদেশ মিশনে যাওয়ার আগে দেখা হয়েছিল ডা. নাজিমের সাথে।
— রাকিব সপরিবারে বিদেশে চলে যাচ্ছ। একবার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসা উচিত।
কোনো উত্তর দেয়নি রাকিব আহমেদ। সেদিন হতে ডা. নাজিম বুঝতে পেরেছিল রাকিবের স্ত্রীর অপছন্দ। সম্ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষিত পরিবারে মেয়ে; তাছাড়া উর্দুভাষী স্ত্রীর বিপক্ষে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি জাদরেল সিএসপি আমলা রাকিব আহমেদের। ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে যায় আলা উদ্দিন মাস্টার সাহেবের সাথে। জানতে চায় রাকিব সম্পর্কে। মিথ্যে বলার মানুষ নন ডা. নাজিম। সত্য কথাগুলো বলেছিলেন অকপটে। আলা উদ্দিন মাস্টার সাহেব শুনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। চোখ দুটো ভরে অশ্রু জমা হয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। চোখ মুছে শুধু বলেছিলেন,
— নাজিম বাবা, তোমার বাসায় চলো বউমাকে দেখে যাই। যদি কোনোদিন আর সাক্ষাৎ না হয়।
সেই যে শেষ দেখা ডা. নাজিমের পরিবারের সাথে। আজও মিসেস নাজিম মনে রেখেছেন। তাই তো রাকাকে নিজের মেয়ের মতো করে আদর করেন। বিধির বিধান কেউ খণ্ডন করতে পারে না। সেই ডা. নাজিমের ছেলে ডা. মাসুদের তত্বাবধানে লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে নিজের শেকড়ে। নিয়তির কি খেলা! আমাদের ভাবনাগুলো কোথায় যেন হঠাৎ থেমে যায়। এক পর্যায়ে হু হু করে কাঁদতে থাকেন রাশিদ আহমেদ। চোখে পড়ে ছোটো ভাইয়ের। কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে থাকেন মেজো ভাই। ঘটনা সংক্ষেপ্তে বলে। পরিবেশটা গম্ভীর হয়ে উঠে মুহূর্তের মধ্যে। পাশে এসে দাঁড়ায় মনিকা। তাকে বলা হলো। মনিকাকে আজ আর শক্ত হতে হবে। সবাই রাকার পাশে এসে দাঁড়ায়।
— রাকা, একটা কথা জানতে চাই যদি আপত্তি না করো।
— বলুন চাচ্চু। কী জানতে চান?
এই প্রথম চাচ্চু ডাক শুনে রাশিদ আহমেদ আবেগতাড়িত হয়ে যান। তিনি মানসিকভাবে নিজেকে শক্ত রাখেন।
— আচ্ছা। গত রাতে কী কোনো স্বপ্ন দেখেছিলে? মানে তুমি তো প্রায় স্বপ্ন দেখে থাকো।
রাকা কিছু সময় নিশ্চুপ থাকে। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।
— হ্যাঁ। দেখেছি। বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আপনাদের বলা ঠিক হবে কি-না তাই বলা হয়নি; আপনারা কী মনে করবেন। কারণ স্বপ্ন তো ব্যক্তিগত অনুভূতি। তবে এখন বলতে বাধা নেই। গতকালের স্বপ্ন ছিল আলাদা। বাবার সাথে দুজনকে দেখলাম। তারা বয়সে বাবার চেয়ে অনেক বড়ো। দুজনের মধ্যে একজন মহিলা ছিলেন। বাবা তাদের হাত ধরে সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তারপর আমার ঘুম ভেঙে যায়। আজ সারাদিন ব্যস্ত থাকায় বাবার খোঁজ নেওয়া হয়নি। যাই মোবাইল করি।
রাশিদ আহমেদ মনিকাকে চোখের ইশারায় রাকাকে থামাতে বলে। রাকা যেন তার বাবাকে মোবাইল না করে। রাশিদ সাহেব তার বোন আরিফাকে আড়ালে ডেকে বিস্তারিত খুলে বলেন। বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে ফুলঝুড়ি গ্রামে। রাকা বাকরুদ্ধ। তার পায়ের নিচের মাটি মুহূর্তে সরে গেল। কোথায় যাবে। কার কাছে যাবে। মা তো এ দেশে থাকবেন না। বাঙাল দেশ তার অপছন্দ। আলিফা এসে রাকা জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়।
— আমার কী হবে, কোথায় যাব? বাবা ছাড়া তো এ সংসারে কেউ নেই। বাবা আমার সব; আমার কলিজা। কোনো দিন নাম ধরে ডাকেনি। মা বলে ডাকতেন আর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেন। কেন? কেন? বাবা এর উত্তর কে দিবে বলে গেলে না। আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে।
কান্না থামে না রাকার। সবাই এসে রাকাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— ওরে কে বলেছে তোমার কেউ নেই। আমি ফুফু, মেজো চাচ্চু, ছোটো চাচ্চু সবাই আছে। তুই তো আমাদের মা। তাই তোর বাবা মা বলে ডেকেছেন।
গ্রামের লোকজন এসে ভরে গেছে মাস্টার সাহেবের বাড়িতে। কত নাম-ডাক সিএসপি’র বাবার বাড়ি। আলাদা একটা কদর এই আলা উদ্দিন মাস্টার সাহেবের। সমবয়সী যারা বেঁচে আছেন তারাও এসে উপস্থিত। সবার মুখে একটাই কথা। এ কেমন খেলা বিধাতা তোমার। সবাই জেনে গেছে অপরিচিত মেয়েটি রাকিবের। সে জানত না এটাই তার পিতৃগৃহ। হায়রে অভাগা মেয়ে। অচেনা জায়গায় মেয়েকে পাঠিয়ে প্রাণহীন দেহ নিয়ে নীড়ে ফিরছে। রাকা তার ফুফু আলিফাকে জড়িয়ে ধরে। এ যেন রক্তের মহামিলন। পাশে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছোটো দু’ভাই। রাকা আরিফা ম্যাডামকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে,
— আমি কে? এখানে আমার কী পরিচয়? যিনি আসছেন এখানে তার কী পরিচয়?
আলিফা ম্যাডাম ধীরে ধীরে ওঠে এসে রাকা জড়িয়ে ধরে বলে,
— এটাই তোর ঠিকানা। তুই আমাদের রক্ত। আমাদের মা। আমাদের মায়ের আদলে তোর চেহারা। প্রথম দেখেই আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে সবুজ মাঠে হেঁটে বেড়াতেন তার বড়ো ছেলে। দেখো, মৃত্যুর আগে আবার স্বপ্নে দেখতে পেলেন ছোটোবেলার স্মৃতি। কী আশ্চর্য! আরও আশ্চর্য তুমি একই স্বপ্ন দেখে ছুটে এসেছ শেকড়ের সন্ধানে। কী আশ্চর্য, তাই না?
সবার অজান্তে পাশে এসে দাঁড়ায় আকাশ।
— চলো, সবাই মিলে আমাদের গর্বের ধন অভিমানী সন্তানকে তার বাবা-মায়ের কোলের কাছে রেখে আসার ব্যবস্থা করি।
নীড়হারা পাখি মাটির নীড়ে থাকবে বলে পুঞ্জীভূত বেদনা নিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।
(শেষ)
ফাল্গুন ২৯, ১৪৩০ ব.
মার্চ ১৩, ২০২৪ খ্রি.
উত্তরা, ঢাকা।
আরও পড়ুন নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
নিঃশব্দে নীড়ে ফেরা ।। ১২শ পর্ব