জারজ (২য় পর্ব)
জারজ (২য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
ঠিক দুদিন পর যথাসময় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুলিশ ইচ্ছে করলে যে কোনো অপরাধীকে আটক করতে পারে। তবে এই মহিলা অপরাধী কিনা আজকেই জানা যাবে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আদৌ জড়িত কিনা তাও জানা যাবে। মাননীয় বিচারক তার আসনে বসে কথিত মহিলাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে নির্দেশ দিলেন। দুজন মহিলা পুলিশ কথিত মহিলাকে কাঠগড়ায় উঠতে বলে নিজেরা একটি দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। কথিত মহিলা একেবারেই অতি সাধারণ। অপরিস্কার একখানা সবুজ রঙের শাড়ী পরিহিতা। শাড়ীর গায়ে কতকাল পানি-সাবান লাগেনি! পায়ে কোন সেন্ডেল আছে কিনা বুঝার উপায় নেই। মুখখানা আলাদা একখণ্ড কালো কাপড়ে আবৃত। পুলিশের ভাষ্য মতে, মহিলা পথচারী ভাসমান ভিক্ষুক। তবে সে উত্তরা মডেল থানার আশে পাশে থাকে। মহিলাকে আসামী দ্বারা সনাক্ত করানো হয়েছে।
উকিল সাহেবকে জেরা করার জন্য অনুমতি দেয়া হল। তার আগে কোর্টের প্রথা অনুযায়ী কথিত মহিলাকে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ করার কথা বললে, সে পবিত্র কোরআনের ওপর হাত রাখতে অসম্মতি জানায়।পুনরায় বলাতে কথিত মহিলা আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে,
_হুজুর, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে? আমি তো আশ্রয়হীন সামন্য একজন ভিক্ষুক। আমি যে অপবিত্র। কেমন করে পবিত্র কোরআন স্পর্শ করবো?
তাকে পবিত্র হয়ে আসার জন্য বলা হলে সে হাত জোড় করে বলে,
_হুজুর, সমুদ্রের সমস্ত পানি দিয়ে ধুইলেও আমার শরীর পবিত্র হবে না। আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি, কোন কিছুই গোপন করবো না। গোপন করার মত কোন কিছু অবশিষ্ট নেই। জীবনের শেষ মুহুর্তে বলার সুযোগ পেলাম। তাই চরম সত্যটা হুজুরের সমীপে বলতে চাই।
মাননীয় বিচারক কথিত মহিলার কথায় বিস্ময়ের সাথে শুনছিলেন। কি ঘটনার সাথে জড়িত আছে যে, পবিত্র কোরআন স্পর্শ করতে নারাজ। অবশেষে জেরা করার জন্য অনুমতি প্রদান করা হল।
আরও পড়ুন গল্প মামৃত্যু
উকিল সাহেব ধীর গতিতে কথিত মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চেহারার দিকে একবার তাকালেন। তার মনে সন্দেহ হল। আসামীর সঙ্গে কথিত মহিলার চেহারায় যথেষ্ট মিল রয়েছে।
_আপনার নাম?
_নাসিমা বেগম।
_স্বামীর নাম?
কোন জবাব নেই। হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আদালতের ভেতরে গুঞ্জন শুরু হলে, সবাইকে শান্ত থাকার আদেশ দেওয়া হল।
_সামনে আসামীর কাঠগড়ায় যে যুবককে দেখতে পাচ্ছেন, তাকে চেনেন কি?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
কিভাবে চেনেন বা জানেন তা বিস্তারিত আদালতের কাছে পেশ করুন। কারণ আসামীর অনুরোধে মাননীয় আদালত আপনাকে এখানে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং মাননীয় আদালতের সামনে যা বললেন, সত্য বলবেন।
আজকের আদালতে কিছু সংখ্যক উৎসুক তরুণ উকিল উপস্থিত আছেন। হাসমত আলী উকিলের আচরণ দেখে তারা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
মাননীয় বিচারক কথিত নাসিমা বেগমকে বলার অনুমতি দিলেন।
এবার নাসিমা বেগম সরাসরি মাননীয় বিচারকের মুখের দিকে তাকাল। মাননীয় বিচারক নাসিমা বেগমের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন! কি আশ্চর্য আসামী যুবকটির সাথে মহিলার চেহারা এত সাদৃশ্য! মহিলা যৌবনকালে নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলো। শুধু তাই নয়, শ্যামবর্ণ হলেও নিঃসন্দেহে সুন্দরী ছিল, এতে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কোনো পরিস্থিতির কারণে তার আজকের করুণ পরিণতি।
_হুজুর, আমার নাম নাসিমা বেগম আগেই বলেছি। আমি গ্রামের এক গরীব গৃহস্থ ঘরের মেয়ে। আমরা তিন ভাই-বোন। আমি সবার বড়। অভাবী সংসার হলেও আমরা স্কুলে পড়াশোনা করতাম। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। পাশের গ্রামে আমার খালার বাড়ি। খালাতো ভাই এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। হুজুর, মিথ্যে বলবো না। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। দুজন-দুজনকে ভীষণভাবে ভালোবাসতাম। হঠাৎ আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের অশিক্ষিত গরীব ঘরের মেয়ে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমাদের মেলামেশা চলছে। খালাত ভাই এসএসসি পাস করার পর, আর লেখাপড়া না করে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। গরীবের সংসার তাই তার লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ছুটিতে বাড়ি আসলে আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসে গোপনে দিত। গরীব মানুষ লোভ সংবরণ করতে পারিনি। খালাতো ভাইয়ের সাথে মেলামেশাতে আমার সর্বনাশ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক
খালাতো ভাই ইদ্রিশ আলী ইদের ছুটিতে বাড়ি এলে, তাকে বিস্তারিত জানাই। সে আমাকে অভয় দেয়। তার সঙ্গে পরামর্শ করে গোপনে ইদের পরে দিন রাতের অন্ধকারে ঢাকায় চলে আসি। বস্তিতে একটা বাসা ভাড়া নেই। আমাদের মত অনেক গার্মেন্টেস পরিবার থাকতো। সবাই জানে আমরা স্বামী-স্ত্রী। বৌকে কাছে নিয়ে এসেছে। এ-ও বলা হলো গত ছয় মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। মিথ্যে বলা ছাড়া আর আমাদের কোন উপায় ছিলো না। ইদ্রিশকে চাপ দিতে থাকি কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সে বিভিন্ন অজুহাত দেখাতে থাকে।বস্তির সবাই জানে আমার বাচ্চা হবে। কিন্তু সবই চলছিলো ধোঁকাবাজির ওপর। ঠিকই আমার গর্ভে বাচ্চা হল। ইদ্রিশ আলীর পরিচয়ে বড় হতে থাকে। কিন্তু ইদ্রিশ আলীর মন-মানসিকতা পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ঘর-সংসারে তার মন নেই। খিটখিটে মেজাজ। আমাদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
ভালোবাসা আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো এক নয়। সম্পর্ক অবনতি হলেও ঘর-সংসার চলছে শূন্যের ওপর। আমার গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলেটি বড় হতে থাকে। সে ক্লাস ফাইভে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় জিপিও-৫ পেয়ে উপজেলার মধ্যে বৃত্তি পেয়েছিল। কিন্তু ততদিন অবৈধ সংসারে আগুন ধরে গিয়েছিল হুজুর।
ইদ্রিশ আলী গোপনে তারই গার্মেন্টসের সহকর্মী একটা মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই মেয়েটি গর্ভধারণ করেছিল। কিন্তু আমার মত ভীতু মনের মেয়ে নয়। সহকর্মীদের সাথে নিয়ে জোড় করে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিল। কি আশ্চর্য হুজুর, আর তাতেই পেটের সন্তান বৈধ হয়ে গেল! তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। আর আমার সাথে প্রতারণা করা হল। আমার ভালোবাসার ফসল অবৈধ হল। আমি এ কুল – ও কুল দুকুল হারালাম। বাবা-মা আমাকে চিরদিনের জন্য সম্পর্ক হতে বঞ্চিত করে দিল। কি আশ্চর্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা! মিথ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। আর আমি অবৈধ সন্তানের মা হয়ে ছেলের কাছে কোন জবাবদিহি করতে পারিনি।
আরও পড়ুন গল্প বিপরীত
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার ছেলে ঘরে নেই। আর কোনদিন তাকে খুঁজে পাইনি। তা তো প্রায় দশ-এগারো বছর হতে চলেছে। সময় চলেছে পানির গতির মত। কেউ বসে নেই। কিন্তু সমাজ সবার জন্য নয় হুজুর। আমি এক অসহায় অসতী নারী। এই পাপ যুক্ত শরীর নিয়ে বেঁচে আছি। ভালোবাসার মানুষটি একজন নারী কাছে সবচেয়ে দামী সম্পদ। বিনিময়ে সংসার পেলাম না। পেলাম অবৈধ সন্তান। আর ভালোবাসার মানুষটি পাষণ্ডের মত, আমাকে আর তার পাপের ফস্ আমার মাথায় চাপিয়ে রাতের অন্ধকারে গাজীপুর ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে সংসার পেতেছে। হুজুর এ সব লোক মুখে শুনেছি। ছেলে কার পরিচয়ে থাকবে। সেও রাতের অন্ধকারে কোথা যেন উধাও হয়ে গেল। আজও তাকে খুঁজে পেলাম না। জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব। ঢাকা থেকে ভোরে যে ট্রেন গাজীপুর স্টেশন পার হয়, সেই ট্রেনের নিচে শরীরটা মেলে দিব।
প্রস্তুতি নিয়ে ঝাপ দিবো, এমন সময় এক মহিলা আমাকে জাপটে ধরে ফেলে। ততক্ষণে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে দেখি একটা চৌকির ওপর শুয়ে আছি। আর সেই মহিলা আমার পাশে বসে আছে। তার ধারণা আমি কোন ভাল ঘরের গৃহ বধূ। শ্বশুর বাড়ির মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আত্ম হত্যার পথ বেছে নিয়েছি। গরীব হলে কি হবে। তার ভেতরে মাতৃত্ববোধ-মায়া-মমতা দয়া ছিল। সব শুনার পর আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু আশ্রয় নয় হুজুর, একটা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু সব আমার ভাগ্য। আমার নিজের ভাগ্যকে সেই দিন কবর দিয়ে এসেছিলাম যেদিন অবৈধ সন্তান শরীরে বহন করে একজন ভণ্ড মুখোশধারী ঠগ মানুষের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে বাবা-মা আর দুই ছোট ভাইকে ছেড়ে এসেছিলাম। অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম কিন্তু যৌবন তো অবৈধ নয়। সতেজ যৌবন। বয়স মাত্র বাইশ-তেইশ। ষোল বছর বয়সে সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম। এখন বয়স কত আর হবে, তবে চল্লিশ হয়নি।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
সে সব থাক হুজুর। যে বাসায় কাজ করতাম, বাসার গৃহিণীর একটা ভাই থাকতো। শুনেছিলাম বেকার, একটা রাজনীতি দলের নেতা। প্রায় রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরত। বড়লোক ভগ্নীপতি। বোনের আসকাড়ায় বাসার কেউ কিছু বলে সাহস পেত না। বাসার ছেলে-মেয়েরা তাকে এড়িয়ে চলত। আমাদের সমাজে বোনেরা ভাইদের দোষ খুঁজে পায় না। পেলেও গোপন রাখার চেষ্টা করে। বাসার ড্রাইভার ভাই আমাকে বলেছিল মালিকের শ্যালকের চরিত্র ভাল নয়। তার জন্য অনেক কাজের মেয়ে কাজ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রায় লক্ষ্য করতাম, আমার দিকে কেমনে চেয়ে থাকত। তার চোখের চাহনি ছিল খারাপ। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। আবার হুকুম তালিম করতে হত। গরীব মানুষের আবার মান-ইজ্জত। একদিন দুপুরে একগ্লাস খাবার পানি নিয়ে তার ঘরে যেতে বলল। তার ঘরটা দোতলার শেষের দিকে। একটু নিরিবিলি। প্রথমে যেতে চাইনি। কিন্তু ম্যাডামের ধমকে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। পানি নিয়ে যাওয়ার পর, আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল তা এখানে বলা সম্ভবপর নয় হুজুর।
নাসিমা অঝরে কাঁদতে শুরু করল। আদালতে কোন শব্দ নেই। চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করল। হুজুর দোষ করলো ম্যাডামের ভাই, আর শাস্তি পেলাম আমি। কি শাস্তি সেদিন আমাকে দেওয়া হয়েছিল দেখবেন? বলেই মাথার ওপর হতে কালো কাপড় সরিয়ে ফেলে, মাথার পিছনটা মাননীয় বিচারকের দিকে ঘুরাতেই, মাননীয় বিচারক তাকে ঢাকতে বললেন। তবে উকিল সাহেব দেখতে চাইলে তাকে দেখানো হল। মাথার পিছনটা আগুনে পুরা। রোমহর্ষক ঘটনা। শাস্তি এখানে শেষ নয় হুজুর। শাস্তি আরো আছে। বাম হাত বের করে দেখালো। হাতের চারটা আঙ্গুলের অর্ধেকটুকু নেই। প্রায় ছয় মাস বিছানায় পরেছিলাম। কিন্তু মরণ আমাকে দেখলো না। আমাদের মত অসহায় মানুষ এ রকমে শাস্তি পায়। ভাল হলাম বটে, কর্ম করার ক্ষমতা রইল না। তাই হয়ে গেলাম পথের ভিখেরী। সারাদিন যা পাই তাই দিয়ে চলি। হুজুর আজকে কি খাবো জানি না। আর আপনার আদালতে কি বিচার হবে তাও জানি না।
আরও পড়ুন তবুও ভালোবাসলাম
এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করল,
একজন গর্ভধারিণী মা হয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেলাম না। এ যে মাতৃত্বের অপমান। একজন মেয়েকে মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে সারা জীবনের জন্য কলঙ্কিত করা হয়েছে। এর বিচার কে করবে?
এজলাস ভর্তি মানুষের মধ্যে নিরবতা বিরাজ করছে। অন্ধকার কবরের মত।
মহিলাকে সম্মানের সাথে রাখা এবং তার খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হল। আগামীকাল সকাল দশ পর্যন্ত আদালত মুলতবি ঘোষণা করা হল।
আরও পড়ুন জারজ-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
জারজ (২য় পর্ব)