একজন-কিশোরীর-প্রেম-১ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

একজন কিশোরীর প্রেম (১ম পর্ব)

একজন কিশোরীর প্রেম (১ম পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

শীতের সকাল। গ্রামে শীতের আমেজ আলাদা। ইচ্ছে করে বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। অনেক দিন পর সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে এসেছে সাগর। গ্রামের লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে সাগর নামেই পরিচিত। সমবয়সী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামবাসী তাকে এই নামে চেনে। এ প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে তার নাম শুনেছে, তবে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি। বছর দুয়েক হলো নিয়মিত গ্রামে যাতায়াতে অনেকেই এখন তাকে চেনে। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয় সাগর। সাগর বাড়িতে এলে আলাদা আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। যে ক’দিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকে, সবার সাথে মিলেমিশে থাকে। ছেলে-মেয়েরা বেশ আনন্দ করে অবকাশ সময় কাটিয়ে আবার সংবদ্ধ জীবনে পা রাখে।

উঠি উঠি করে ওঠা হচ্ছে না। এদিকে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী এসে তাড়া দিয়ে গিয়েছে, গরম গরম ভাঁপা পিঠে আর গুড়ের তৈরি চা। আহারে গুড়ের তৈরির চায়ের কথা শুনেই মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা। আর সাথে সাথে বাবা-মায়ের মুখ ভেসে উঠে সাগরের হৃদয়ে।

শীতের সময় সাত সকালে মা গুড় দিয়ে চা বানিয়ে তাদের তিন ভাই বোনদের ডাকতেন। বাবা তখন হাঁসেল ঘরের এক কোণে বসে মুড়ি দিয়ে চা পান করতেন। গুড়ের তৈরি চা-মুড়ির আলাদা একটা প্রাণ জুড়ানো মৌ মৌ গন্ধ নাকে এসে ঢুকতো। তাদের বাড়িটা ছিলো গ্রামের অন্য বাড়ি হতে স্বতন্ত্র। মাস্টার সাহেবের বাড়ি, আবার কেউ বলতেন পন্ডিত স্যারের বাড়ি। এখন সে বাড়ি নেই, বাবার নামও কেউ বলে না। ছোট ভাইদের নামেই পরিচিত।

আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে

মানুষ যতোই অভিজাত শ্রেণিতে পর্দাপন করুক না কেন গ্রাম তার গোঁড়াপত্তন। নৃবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান তাই বলে। ইদানিং সাগর কেন যেন একটু অকারণে বেশি চিন্তা করে। এটা কি বয়সের কারণে, না অন্য কিছু? কম্বলের নীচে শুয়ে চিন্তা করতে বেশ লাগছে আবার গুড়ের তৈরি চা। হঠাৎ ছোট ভাই রাজনের ডাক শুনে চিন্তা বাধা পেলো। অগত্যা উঠতে হলো। নীচে বসার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সমবয়সী একজন লোক সোফায় বসে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে আদাব দিয়ে বললো,
──কি-রে, দেখতো চিনতে পারিস কিনা?
ভালো করে দেখে নিলো সাগর। সমবয়সী হলেও শারীরিকভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ মনে হলো। অনেকক্ষণ দেখার পর চিনতে ভুল হলো না।
──আ-রে, বি-ম-ল না?
──যাক বাবা, চিনতে পেরেছিস। মনে আছে, ছোটবেলায় ফাঁদ পেতে বক ধরার কথা?
──তা আবার মনে থাকবে না। বাড়িতে এলেই সেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। শুয়ে শুয়ে সেই কথাগুলোই ভাবছিলাম।
──শোন, তোর ভাবনার কথা পরে হবে। অনেক কষ্ট করে তোর দেখা পেয়েছি। তোর বৌদিকে কথা দিয়ে এসেছি, আমাদের ছোট বেলার বন্ধু সাগরকে এবার ফাঁদে ফেলবো। ফাঁদ পেতে এসেছি।
──আগের মতোই আছিস। হেয়ালি করে কথা বলার তোর জুড়ি নেই।
──দ্যাখ, সব বন্ধু তো আর নেই। কি জানি আর দেখা হবে কি-না কে জানে । তোকে দেখতে চায় তোর বৌদি। তোর বৌদি বলে ” অল্প অল্প গল্প শুনে ভালোবেসেছি।”
──বাহ! রসিক মনের বৌদি তো। নির্ভয়ে গিয়ে বলবি “সাগর আসছে তুফান বেগে।”
──কি রে, তুই আবার কবি হলি কবে? যে ছেলের মুখ দিয়ে কথা ফুটতো না, এখন দেখি কবিতায় কথা বলে। যাই তাহলে।

আরও পড়ুন গল্প  স্বপ্ন জল

সকালে গুড়ের তৈরি চা আর ভাঁপা পিঠে খেয়ে ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেল যোগে বিমল দাসের বাড়ি পোঁছে গেলো সাগর। ছোট ভাইকে বলে দিলো, ফোন করবে কখন আসতে হবে। ইচ্ছে করেই মুঠো ফোন সঙ্গে নেয়নি সাগর। মনের মতো আড্ডা দিবে। কতকাল পরে কিশোর বেলার বন্ধু পেয়েছে। বিমলদের আগের সেই বাড়ি নেই। বাড়ির চারপাশে বলতে গেলে কত রকমের গাছগাছালি ছিলো। সাগরের প্রিয় ছিলো পেয়ারা আর প্রদীপের প্রিয় ছিলো লেবু। কমল পোদ্দারের ছিলো শসা। ছোটখাটো সুন্দর চেহারা ছিলো কমলের। পাঁচ-ছয় জন বন্ধু ছিলো সাগরের। একমাত্র সাগর মুসলমানের ছেলে। ওর বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেই হিসেবে একটু আলাদা খাতির ছিলো।

সাগর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত হাফপ্যান্ট পরিধান করতো। তাই সাগরকে আলাদা সম্প্রদায়ের লোক হিসাবে চিহ্নিত করার উপায় ছিলো না। আবার সাগরের বাবা কলারওয়ালা লম্বা শার্ট আর পায়জামা পরিধান করতেন। হিন্দু-মুসলিম উভয়ের সঙ্গে ছিলো সদ্ভাব এবং তাঁকে সবাই সমীহ করতেন। এখন সেই দিন আর নেই। বলতে গেলে শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায় বেশির ভাগ লোক গত ষাট বছর হলো চলে গেছে। বিশেষ করে ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধের পর বেশিভাগ হিন্দু ওপার বাংলায় পাড়ি জমিয়েছে। সাগরের চিন্তায় বাধা পরলো বিমলের ডাক শুনে।
──এই সাগর ভেতরে আয়। বাসন্তী, বরণ করো তোমার স্বামীর বন্ধু সাগরকে।

বাসন্তী বিমলের স্ত্রী। শীতের সকাল বাসন্তীর চেহারা দেখতে হবে। বেশ মজাই লাগছে। ছোট ভাইকে বিদায় দিয়েছে। বন্ধুপত্নী বাসন্তীকে দেখার জন্য সামনে চোখ মিলে তাকালো সাগর। বাসন্তী বটে! চওড়া গাঢ় লাল পেড়ে ঘিয়ে রঙের সিল্কের শাড়ী পরিহিতা একজন মহিলা সামনে এসে দাঁড়িয়ে, করজোড়ে প্রনাম করে ভেতরে যাওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ করলো। বসার ঘর বটে। গ্রাম আর গ্রাম নেই। বলতে গেলে শহর। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি সাজানো ছোট্ট ঘর। আগেই শুনেছে বিমলের দু’ছেলে ভাল চাকরি করে। বেশ ভালো লাগলো সাগরের। একটা খালি চেয়ারে বসলো।
──আপনার গল্প এত শুনেছি যে, আপনাকে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাদের বিয়ের পর হতে শুনে আসছি সাগর-প্রদীপ-কমল-বিমল। আজ সেই আশা পুরণ হলো চার বন্ধুর একজন সাগরকে দেখা পেয়ে।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

মহিলা যৌবনকালে দেখতে পরিস্ফুট গোলাপের মতো ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই। বয়সের ভারে অনেকটা মলিন হতে চলেছে। তবে কথা বলার ভঙ্গি আর্কষণীয়। সাবলীল সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলে গেলেন। সহজে নজরে কাড়ার যাদু আছে বৌদির। সাগর রোমাঞ্চিত হলো। বন্ধুপত্নি বটে সকালটা বৃথা যাবে না। বিমল ফাঁদ পাতার কথা বললো কেন?
──আজ আপনাকে নতুন একটা জিনিস দেখাবো। চিনে নিতে হবে কোন কাননের ফুল।
ওমা, এ যে দেখি কথাশিল্পী। কিন্তু কোন কাননের ফুল। এটা আবার কি? ভাবনায় পরে গেলো সাগর। হঠাৎ গাঁদা ফুলের মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো সাগরের। মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অন্য রকম অনুভূতি সৃষ্টি হলো। নিঃশব্দে একটা মহিলা পিছন হতে এসে সাগরের পাশে রাখা একটা খালি চেয়ারে বসলো। সাগর একটু আশ্চর্য হয়ে আড়াচোখে এক নজর অপরিচিতা মহিলার দিকে তাকালো। কিন্তু চেহারা সম্পূর্ণভাবে দেখতে পেলো না। চুলে ঢাকা অর্ধেক মুখ। চওড়া লাল পেড়ে ঘিয়ে রঙের গরদের শাড়ি গায়ে, লাল ফুলহাতা ব্লাউজ পরিহিতা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী মহিলা ডান হাত বাড়িয়ে এক মুঠো গ্যাঁদা ফুল সাগরের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,
──সুপ্রভাত এবং ফুলের শুভেচ্ছা।
সাগর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে তো কবি বা সাহিত্যিক নয়। বিজ্ঞানের ছাত্র। কি বলবে। সামনে বিমল-বাসন্তী মজা করে দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে। সাগর ভাবছে এই কি সেই কোন কাননের ফুল আর বক ধরার ফাঁদ? সাগর এই মুহুর্তে কোন জবাব দিতে পারছে না বা তার মুখ হতে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।

আরও পড়ুন কপিশ নয়ন-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একজন কিশোরীর প্রেম (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!