আড়ালের চোখ
আড়ালের চোখ
নাসির ভাইদের বাড়ির পাশে খোলা মাঠ, তার সঙ্গে আবাদি জমি। ডীপ মেশিনের পানি দিয়ে ধানের আবাদ করে। ধানের মাঠ বাড়ি থেকে দেখা যায়। কেউ কেউ গোসল করতে আসে। মামী আমাকে সেদিন বলেছিল,
──আমরা ডীপ মেশিনে গোসল করতে যাব।
আমি আর ছোট মামী একসঙ্গে গোসল করতে গেলাম। ডীপ মেশিনের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে পরান ডা জুড়িয়ে যায়। পানি এত ঠাণ্ডা! গোসল করার পর মনে হয়, সারা দিনের ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে যা।
কোনো কোনো দিন বিদ্যুৎ না থাকলে একটু বসে থাকি, বাঁশের একটি পুরাতন মাচালের উপর। কত বিচিত্র রকমের গল্প হয় সেখানে! আমাদের দেখাদেখি অনেকেই এখানে গোসল করতে আসে। প্রতিদিন ছোট-খাটো একটা গল্পের আড্ডা হয়ে যায়। একজনের স্বামী বিদেশ থাকে, আরেকজনের স্বামী রাগ করে চার মাস বাড়ি আসে না। কেউ স্বামীর সঙ্গে সংসার করছে, কিন্তু শারীরিক কোনো অন্তরঙ্গতা নেই। কে তরকারিতে তৈল কম দিয়েছে, কার স্বামীর চেহারা সুন্দর, কে বেশি টাকা বেতন পায়, কে বউকে বেশি ভালোবাসে। কত কিসিমের মানুষ যে গোসল করতে আসত! একজন মনে হতো হাজার রকমের গল্প বলতো।
গোসল করবার সময় আশেপাশের লোকজন যাতায়াত করত, বোয়াল মাছের মত হা করে তাকিয়ে থাকতো।
মামীকে একদিন বলেছিলাম,
── মামী, নাসির ভাইদের ডীপ মেশিনে গোসল করতে গেলি-তো, বেটা মানুষ ক্যামবা কইরে যেন চাইয়ে থাহে।
── ঐ মাগি, তুই বেটা মানুষ দেখলি কিরাম করে। গোসল করবের সময়, দু-একজন বেটা মানুষ গেলি কী হবি তোর?
──ভিজা কাপড় নিয়ে গেলি, নাসির ভাইও তো চাইয়ে থাহে রাক্ষুসের মতো। তার চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট বুঝা যায়। প্রথম দিকে তাকে ভালো মানুষ মনে হতো।
── ওরে আল্লাহ্ রে! নাসির রাক্ষস হয়ে গ্যালো তোর কাছ? এই জন্যিইতো কয়, কুয়ের ব্যাঙ সাগরে পড়লি যা হয়। ইরে, নাছিমা,
── তোর কাম কী খালি ব্যেটা মানসের দিকে তাকিয়ে থাকা? গোসল করে সোজা বাড়ি চলে যাবু কচ্ছি। তেল হয়া গেছে হারামজাদির শরীরে, তাইনি?
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
আমি ওড়না ভালভাবে চিপে পানি ঝড়িয়ে রোদে নেড়ে দিতেই, পাশের বাড়ির রুহুল মামা হুট করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। গলায় একটু কাশি দিয়ে যে ভেতরে আসবে তা না। চোরের মত কোণা কাঞ্চি দিয়ে বাড়ির ভেতর এসে হুট করে বলল,
── ভাই কী বাড়িতে আছে?
এরা মিসকা শয়তান, আমি এদের খুব ভালো করে চিনি, আমার শরীরের দিকে ওদের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি দেখলেই আমি বুঝি। আমি দৌড়ে গিয়ে পাশের রুম থেকে ওড়না নিয়ে সামনে দাঁড়ালাম।
── কী মামা, কিছু কতি চাইছেন মনে কয়?
── তোদের বাড়িতে দেখছি আজ কেউ নাই রে গেদি। এত দিন পরে আসলেম, একটু বসার কথা কচ্ছিসনে ক্যারে? আজ খুব রোদ পড়েছে তাইনেরে নাছিমা?
একটু একটু করে এগিয়ে এসে একেবারে ঘরের চৌকাঠ নাগাদ এসে দাঁড়াল,
আমি বুঝতে পারলাম। মামার ভাব ভালো মনে হলো না, আমার হাতের কাছে বটি ছিল। কৌশলে হাতে নিয়ে খুব মিষ্টি সুরে বললাম,
── মামা আমি কদু কাটতি যাবো, বাড়িতে কেউ নাই। আপনি পরে আসতি পারেন।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বাড়ি পলাতক শিশুর মত মাথা নিচু করে চলে গেল।
আমার বুকের ভেতরে ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে তখনো।
সেদিন গোসল দিয়ে আসবার পথে সরদার বাড়ির সামনে অল্প বয়সি একজন চিঠি দিল আমার হাতে। আমি চিঠি হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
── কিরে, কেডা লেহিছে পত্র খানা?
── সাইফুল দিছে।
──পিয়ন হইছিস? তোক বাপের কাছে কবো দাঁড়া।
ছেলেটি ভয় পেয়ে গেল। আমি হালকা হেসে তাকে আশ্বস্ত করলাম। যা এখন বলবো না।
এ কথা শুনে বাতাসা পাবার আনন্দের মতো দৌড় দিল।
── আমি অবাক হলাম! আমাকে কেউ ভালোবাসাতো পারে? যে সাইফুল আমার দিকে কখনো ফিরেও তাকাইনি, সে আমাকে চিঠি লিখেছে! ভেবে বেশ পুলকিত হলাম। বাড়ি গিয়ে বইয়ের ভেতর রেখে দিলাম। আবডালে গিয়ে পড়ছিলাম, হঠাৎ মামীর হাতে ধরা খেলাম,
── তলে তলে এত কিছ?
আমি লজ্জায় এক দৌড়ে অন্য ঘরে চলে আসলাম। আমার পেছনে-পেছনে মামী এসে হাজির।
── খবরদার, ঐ হারামির সঙ্গে কিন্তু প্রেম টেম করিস নে। দেখি চিঠিতে কী লিখছে খাচ্চোরটা?
আরও পড়ুন গল্প কবর
মামীর কথা কঠিন হলেও মিশ্রিত থাকত অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা। মামীর মুখের ভাষা ছিল ভিন্ন রকম। মামী যদিও আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করে, তবুও মনের ভেতরে ভয়ও কাজ করছে। যদি মামাকে কিছু একটা বলে দেয়। অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। মামীর চেহারা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আমার উপর রেগে আছে, না কী জিদ করে আমার সঙ্গে এমন করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।
কথায় বলে, পরিচিত মানুষকে যতটুকু চেনা যায় তার চেয়ে চেহারা দেখে বেশি অনুমান করা সম্ভব।
আমি মামীকে দেখে অনুমান করছিলাম যে, তিনি রেগেছেন কী না। ঘরে হারিকেনের আলোর খুবই দুরবস্থা। সলতে নেই, আলো টিপটিপ করে জ্বলছে। মুখের কাছে হারিকেন নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম,
── মামী, কাউকে বলবেনা তো? আগে কথা দাও।
পর মানুষগুলো আপন হয় শুধুই ভালোবাসার টানে। মামী আমার সম্পর্কের দিকে খুব কাছের কেউ কিন্তু নয়। আমার সৎ মামার দ্বিতীয় বউ। আমার সঙ্গে প্রায় সময় বিভিন্ন ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে দু’চার কথা হরহামেশা হচ্ছে। তবুও কোনো কিছু মনে রাখে না। খুব সহজ সরল মনের মানুষ।
── আমার মাথা ছুঁয়ে কও, কারও কাছে বলবা না?
── আমারে তুই অবিশ্বাস করিস? যা তোর চিঠি পড়ব না। একথা বলে অভিমান করল মামী।
── কও না, কারো কাছে বলবে না?
── ইরে আল্লা রে কলাম তো, বলবো নানে।
হঠাৎ মামীর চোখের জল টলমল করছে। সানন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
কিছুদিন যাওয়ার পরে, সাইফুলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পথিমধ্যে। বিশেষ কোনো কথা হল না। চোখা-চোখি হলো। পাশে একটা চিরকুট ফেলে দিল। ইশারায় আমাকে ইঙ্গিত করল, তুলে নিতে। হাত থেকে কিছু একটা পরে গেছে এমন একটা ভাব নিয়ে চিরকুট মাটি থেকে তুলে নিলাম। পড়বার জন্য মন বড্ড আনচান করছে। মনের ভেতরে সব সময় একটা দ্বিধা হতো, কেউ কিছু দেখে ফেলল কিনা।
আড়ালের চোখ দিয়ে মানুষ কত কিছুইতো দেখে।
আরও পড়ুন গল্প তবুও ভালোবাসলাম
একটা ব্যাপার বেশ ভাবাত আমাকে। আমি প্রায় সময় দেখতাম, মামী মন খারাপ করে বসে থাকত। আমি প্রশ্ন করলে, তেমন কিছু বলতে চাইত না। তার বিশেষ একটা কারণ ছিল, যা আমি কখনো জানতাম না।
একদিন কথায় কথায় মামী নিজেই আমাকে বলেছিল,
__নৌকা বোঝাই পাট নিয়ে একদিন দৌলতদিয়া ঘাটে আটকে ছিল আনাই মামা। সেখানে কাকতালীয়ভাবে মামার সঙ্গে বিয়ে হয়। মামীর জীবন ছিল অন্ধকারময়। তারপর থেকে আর কখনো মামী বাড়ি যায়নি। সব নাকি ভুলে গেছে। কোথায় বাড়ি ছিল, কিছুই মনে করতে পারে না। ছোট বেলায় কে যেন মামীকে অন্ধকার পল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে; আনাই মামা বিয়ে করার পর।
এত সুন্দর মায়াবী চোখ, দেখতে কী সুন্দর! ভাবতাম, মানুষ কি করে মানুষকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে দেয়? কোন পুরুষ মানুষ কোন দৃষ্টিতে তাকালে কী চায়, মনের ভেতরে কি কাজ করে, অনেক কিছুই মামী খুব সহজেই বলে দিতে পারত অতি সহজে। আমি অবাক হতাম! মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার সত্যিই অনেক মূল্য।
মানুষ খুব সহজে ভালো জায়গা, ভালো পরিবেশ, ভালো মানুষ থেকে খারাপ মানুষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু খারাপ মানুষ ভালো হলে আর কখনো খারাপ হয় না। মামী তাদের মধ্যে একজন।
সাইফুল আমাকে কাছে পেতে চাইত। তার বিভিন্ন চিঠির ভাষা আমাকে বিমোহিত করত। আমিও সাইফুলকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। নদীতে বা পোদ্দার বাড়ির শান বাধানো পুকুর ঘাটে গোসল করতে গেলে; সাইফুল অনেক সময় পেছনে পেছনে আসত। কিছু একটা বলতে চাইত। আমাকে নিয়ে বিস্ময়কর বর্ণনা দিয়ে পত্র লিখত।
আগে নাসির ভাইদের ওখানে গোসল করতে যেতাম। বিদেশ থেকে নাসির ভাইয়ের ভাই ফোন পাঠিয়েছিল। তা দিয়ে আমার ছবি তুলতে চাইত।
মামী জানত বিষয়টা। নাসির ভাইকে ডেকে একদিন খুব করে বকাবকি করেছে। বেচারা লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিল। সেদিন দেখেছি, মাথা নিচু করে আমার দিকে আড় চোখে তাকাল একবার। আমি মুচকি হেসে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম।
আরও পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী
আমি তখন কলেজে পড়ি। আমাকে দেখলে অনেকেই চুপিসারে কানাঘুষা করে। একজন আরেকজনকে টিপুনি কাটে। বিষয়টা আমি বুঝতে পারি যে, ব্যাপারটা আমাকে নিয়েই। কিন্তু কেউ আমাকে সামনাসামনি কিছুই বলছে না।
বিষয়টা নিয়ে আমি মামীর সঙ্গে কথা বলি ক’দিন পর। মামী কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে আমাকে বলেছিল,
__আমার গোসল করবার সময় নাসির ভাই ভিডিও করেছিল গোপনে। তার কিছুদিন পরেই মানুষের মোবাইলে সেই ভিডিও দিয়ে দেয়।
কথাটি শোনার পর লজ্জায় ঘৃণায় নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। প্রচণ্ড ঘৃণা হলো মানুষটার উপর। যে মানুষটাকে আমি এত শ্রদ্ধা করতাম, সেই মানুষটা আমার সঙ্গে এমন করতে পারল!। মুখোশ পরা এ সব শয়তান মানুষ আড়ালের চোখ দিয়ে মানুষকে উদ্যোম করে দেখে। ছিঃ! ভাবতেই ঘৃণা লাগে।
এরপর আমি শহরে চলে আসি। সাইফুল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ছে তখন। আমাদের পরিবার থেকে বিয়ের জন্য সাইফুলের সঙ্গে কথা বলেছিল। সাইফুল অস্বীকৃতি জানায় ঐ ভিডিওটার জন্য। একটি ভিডিও বদলে দেয় সাইফুলের মনটাকে। আমার ভালোবাসার শক্তি মিয়্রমাণ হয়ে পরে। তারপর থেকে আমার সঙ্গে সাইফুল আর যোগাযোগ করেনি। আমি পরের বছর ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়ে যাই।
দেড় যুগ পর!
নাটকীয়ভাবে সাইফুলের সঙ্গে আমার দেখা হয় আই.সি.ইউ’তে। সাইফুল কেন ভর্তি জানতে পারিনি, তবে জানতে চাইনি বলেই হয়তো। আমার রুমে যাওয়ার সময় বাইরের স্বচ্ছ গ্লাসের ফাঁক দিয়ে সাইফুলকে আড়ালের চোখ দিয়ে দেখছিলাম। ঠিক যেমন করে আমার উদ্যোম শরীর দেখত!
মোবাইলের নীল আলোতে বাইরে তখন পৃথিবীর সূর্যটা আত্মসমর্পণ করছে পশ্চিমের বুকে ধীরে ধীরে।
আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
পুরাতন বটবৃক্ষ
নীরুর মা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আড়ালের চোখ